ফাইল চিত্র।
এই বৎসরের বাজেটের মূল সুরটি পরিকাঠামোর তারে বাঁধা ছিল। কৃষিক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। কোভিড-মোকাবিলার প্যাকেজ ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী যে কৃষি পরিকাঠামো তহবিলের কথা বলিয়াছিলেন, বাজেট ভাষণে তাহার কথা ফিরাইয়া আনিলেন। আশা করা চলে, সরকার কৃষিক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকাঠামো গড়িয়া তুলিতে পরবর্তী পদক্ষেপগুলিও করিবে। এক্ষণে অবশ্য কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভারতীয় কৃষি, এবং বৃহত্তর অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতি, দীর্ঘ দিন ধরিয়াই রক্তাল্পতায় ভুগিতেছে। ঋণের জালে জড়াইয়া কৃষকদের আত্মহত্যা, গ্রামীণ ভারতে ভোগব্যয়ের প্রকৃত পরিমাণ হ্রাস, মহারাষ্ট্রের কৃষক পদযাত্রা হইতে বর্তমান কৃষক বিক্ষোভ— বিভিন্ন সূচকে গ্রামীণ অর্থনীতির বেহাল চিত্রটি ধরা পড়িতেছে। এই বাজেটে তাহার ব্যবস্থা হইল কি? বাজেটে পিএম-কিসান খাতে বরাদ্দ কমিয়াছে। কৃষি, সমবায় ও কৃষককল্যাণ দফতরের বরাদ্দও অনেকখানি কমিয়াছে। অর্থাৎ, কৃষকের প্রত্যক্ষ আয়বৃদ্ধি, এবং কৃষির উন্নতিসাধনের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধি, এই বাজেট দুইটি পথের একটিকেও বাছে নাই। দুর্ভাগ্যজনক, কারণ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে কৃষকদের জন্য প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল বিজেপি। মাত্র দেড় বৎসরেই প্রতিশ্রুতিভঙ্গ কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে সহায়ক হইবে না।
২০২৪ সালের মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে আয় ২০১৯ সালের দ্বিগুণ করিবার প্রতিশ্রুতিটিও এই বাজেটে দিশা হারাইয়াছে। কোন ফসলের ক্ষেত্রে কৃষকরা কত বেশি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাইয়াছেন, অর্থমন্ত্রী বিস্তারিত জানাইয়াছেন। কিন্তু, তিনিও বিলক্ষণ মানিবেন যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষি সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানসূত্র নহে। কোনও বৎসর ফসলের দাম পড়িয়া গেলে তাহা বিমার কাজ করিতে পারে, কিন্তু এই সহায়ক মূল্য কৃষকের আয়ের মূল উৎস হইতে পারে না। কৃষি যাহাতে প্রকৃতার্থেই লাভজনক হইয়া উঠিতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে নীতি প্রণয়নই সরকারের দায়িত্ব। অন্য দিকে, সহায়ক মূল্য কৃষিকে ক্রমেই অ-লাভজনক ও অ-সুস্থায়ী পথে ঠেলিতে থাকে। যেখানে ভূগর্ভস্থ জলস্তর কম, সেখানেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের প্রলোভনে জলনিবিড় ফসলের চাষ হয়। তাহা পরিবেশের পক্ষেও ক্ষতিকর, কৃষির ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেও। ভর্তুকি কমাইবার নীতির বিপরীতে হাঁটিয়া এই বাজেটে সারে বিপুল ভর্তুকির ব্যবস্থা হইয়াছে। তাহাও চরিত্রে ‘রিগ্রেসিভ’— এই ভর্তুকি সর্বদাই অবস্থাপন্ন কৃষকের অধিকতর লাভের ব্যবস্থা করে। ফসল বিমা, সহজ কৃষি ঋণ, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের এই প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাগুলির আওতায় আনা— বাজেটে এই প্রসঙ্গগুলির উল্লেখ না থাকা কৃষি ও কৃষকের পক্ষে সুসংবাদ নহে।
গত এক বৎসরে স্পষ্ট হইয়াছে যে, শহর বিমুখ হইলে গ্রামীণ অর্থব্যবস্থাই বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকের আশ্রয় হইয়া উঠে। তাহার একটি দিক যেমন কৃষি, অন্য দিকটি অ-কৃষি শ্রমও বটে। কোভিড-সঙ্কটের মধ্যে গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা বহু মানুষের একমাত্র ভরসা হইয়া উঠিয়াছিল। ইহা অনস্বীকার্য যে, সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকার এই যোজনায় অর্থবরাদ্দ বাড়াইতে দ্বিধা করে নাই। বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৬১,৫০০ কোটি টাকা— কিন্তু প্রকৃত ব্যয় হইয়াছিল ১,১১,৫০০ কোটি টাকা। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী কর্মসংস্থান যোজনায় বরাদ্দ করিলেন ৭১,০০০ কোটি টাকা— গত বৎসরের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় বেশি, কিন্তু প্রকৃত ব্যয়ের তুলনায় ৩৪ শতাংশ কম। অতিমারিজনিত আর্থিক সঙ্কটের রেশ যে এখনও মিলায় নাই, এই যোজনায় কর্মসংস্থানের চাহিদা যে ক্রমেই বাড়িতেছে, এই কথাগুলি জানিয়াও বরাদ্দে কাটছাঁট গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও বিপন্ন করিবে বলিয়াই আশঙ্কা।অতিমারি করোনা বিপদটিকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে। বৃহৎ বপুর সমস্যা। পুষ্টিযুক্ত খাদ্য অধিক মানুষের লভ্য। ফল যাহা হইবার, তাহাই হইতেছে। বপুর সমস্যায় ভুগিতেছে প্রচুর মানুষ। করোনা আবার তাহাদেরই বেশি আক্রমণ করিতেছে, যাহাদের দেহটি স্থূলকায়। যাহারা কৃশকায়, অতিমারি তাহাদের অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি করিতেছে। স্থূলত্বের সহিত যদি মধুমেহ রোগটিও থাকে, তাহা হইলে তো কথাই নাই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৫ হইতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বের নানা প্রান্তের মহিলা এবং পুরুষগণের ওজনের হিসাব করিয়াছে। আঠারো বৎসর বা তদূর্ধ্ব বয়সিদের মধ্যে নারী-পুরুষ, উভয়েরই ওজন ঊর্ধ্বগামী।
এই সমস্যাটির চার ধরনের কারণের কথা বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেন। প্রথম কারণ, আহার্যের সংস্থান বাড়িয়াছে। সবুজ বিপ্লবের পর শস্যের ফলন বাড়িয়াছে। ধনী রাষ্ট্রে যেমন, তেমনই দরিদ্র দেশেও। সবুজ বিপ্লবের পরবর্তী কালে আসিয়া গিয়াছে জিন-প্রযুক্তি। অধিক খাদ্যগুণসম্পন্ন শস্য এখন মানুষের হাতের কাছে। তাহার ফলেও মেদবৃদ্ধি ঘটিতেছে। স্থূলত্বের দ্বিতীয় কারণ খাদ্যে শর্করাবৃদ্ধি। তৃতীয় কারণ, মানুষের জীবনযাত্রা এক্ষণে প্রসেসড ফুড-নির্ভর। জীবন ইদানীং জটিল, গৃহে আহার্য প্রস্তুতে বিড়ম্বনা, তাই প্যাকেটজাত খাদ্যে মানুষের আগ্রহ বাড়িয়াছে। স্ন্যাক্স এবং ফাস্ট ফুডে শর্করা, লবণ এবং চর্বির পরিমাণ বেশি। ক্ষতিকর ওই সব উপাদান আহার্যকে সুস্বাদু করিয়া তুলে। প্যাকেটজাত খাদ্য যে হেতু বহুজাতিক কোম্পানিগুলি তৈরি করিয়া থাকে, এবং ওই সব কোম্পানি যে হেতু নিরন্তর প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে, সেই হেতু অধিক লাভের লোভে কোম্পানিগুলি বেশি সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুতে মগ্ন থাকে। স্থূলত্বের চতুর্থ কারণ হিসাবে যাহা চিহ্নিত হইয়াছে, তাহাও আধুনিক জীবনযাত্রা-প্রসূত। মানুষ ইদানীং কায়িক শ্রম কম করে, করিবার প্রয়োজনও তাহার হয় না। চেয়ারে বসিয়া কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের পর্দার দিকে তাকাইয়াই তাহার দিন কাটে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞগণ এই কারণটিকে গড়পড়তা মানুষের মেদবৃদ্ধির প্রধান উৎস বলিয়া গণ্য করিয়াছেন।
মেদ কী কী কারণে বাড়ে, তাহা জানিবার পর বাকি থাকে সমস্যা লাঘবের চেষ্টা। যে দুইটি অভিনব পরামর্শ এই প্রসঙ্গে উত্থাপিত হইয়াছে, তা উল্লেখের দাবি রাখে। একটি প্রস্তাব হইল ফাস্ট বা জাঙ্ক ফুড হইতে মানুষকে ফিরানোর লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ। সরকারের তরফে কর বাড়াইয়া ইহা করা যাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে উক্ত খাদ্যদ্রব্যগুলি মহার্ঘ হইবে, এবং মানুষ দামের কারণে ওইগুলি হইতে পিছাইয়া আসিবে— ইহাই লক্ষ্য। অন্য যে পরামর্শটি আসিয়াছে, তাহাও প্রণিধানযোগ্য। খাদ্য যে হেতু একটি অভ্যাসমাত্র, এবং যে হেতু ইত্যাকার অভ্যাস দানা বাঁধে বাল্যে, সেই জন্য বালক-বালিকাদিগকে ফাস্ট এবং জাঙ্ক ফুড হইতে দূরে রাখা শ্রেয়। কী উপায়ে তাহা সম্ভব? প্রস্তাব, বিদ্যালয়গুলির অনতিদূরে কোনও ফাস্ট ফুডের দোকান খুলিতে না দেওয়া। দোকান খুলিতে যে লাইসেন্স প্রয়োজন, তাহাতে কড়াকড়ি আবশ্যক। এই মর্মে লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাহাম ম্যাকগ্রেগর ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে লিখিয়াছেন, খাদ্য-শিল্পকে কোনও মতেই জনগণের মাথায় চড়িতে দেওয়া উচিত নহে। কথাটি রাজনীতিকরা বুঝিলে মঙ্গল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy