Advertisement
E-Paper

বিলম্বের অপরাধ

বিচারব্যবস্থার স্তম্ভটি দুর্বল করিয়া দেশকেই দুর্বল করিতেছে গণতান্ত্রিক সরকার।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২১ ০৫:৩৭
Share
Save

পশ্চিমবঙ্গের নিম্ন আদালতগুলিতে প্রায় পঁচিশ লক্ষ মামলা জমিয়া আছে। তাহার মধ্যে উনিশ লক্ষ ফৌজদারি মামলা। মহকুমা, জেলা আদালতের আলোকহীন বদ্ধ কুঠুরিগুলিতে বকেয়া মামলার স্তূপীকৃত নথিপত্র, তাহার এক-একটির অভ্যন্তরে এক-একটি খণ্ডিত জীবন। কত বৃদ্ধ পিতামাতা আশা করিয়া আছেন যে, মৃত্যুর পূর্বে সন্তানের হত্যাকারীর সাজা দেখিয়া যাইবেন। লুণ্ঠিত ব্যক্তি ভরসায় বুক বাঁধিয়াছেন, আদালতের নির্দেশে হৃতসম্পদ ফিরাইবে প্রতারক। সকল ভীতিপ্রদর্শন, কটূক্তি অগ্রাহ্য করিয়া কত না তরুণী দিন গুনিতেছেন ধর্ষক-নির্যাতনকারীর শাস্তির রায় শুনিতে। সর্বোপরি, কয়েক সহস্র কারাবন্দি জামিন পাইবার জন্য দিন গনিতেছেন। অপরাধের অভিঘাতে মানুষের জীবন কক্ষচ্যুত হইয়া যায়। ন্যায়প্রত্যাশী মানুষ কেবল জয়লাভের আকাঙ্ক্ষায় বসিয়া নাই, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিবার অপেক্ষাতেও আছেন। জাতীয় স্তরে সংগৃহীত তথ্য হইতে জানা গিয়াছে যে, পশ্চিমবঙ্গে দশ হাজার মামলা অন্যূন ত্রিশ বৎসর ধরিয়া চলিতেছে; তাহার তিনগুণ মামলা বিশ বৎসর হইতে ত্রিশ বৎসর। এই সকল মামলার সহিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সকলে জীবিত নাই। যাঁহারা আছেন, তাঁহারাও অপূর্ণ, অনিশ্চিত জীবন কাটাইতেছেন। ভারতে এমন বিচার-বঞ্চনার ভয়ানক কাহিনি অগণিত। অথচ, দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করিবার কর্তব্যটি কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনও সরকারের নিকটই যথেষ্ট গুরুত্ব পায় নাই। কলিকাতা হাই কোর্টে বিচারপতির অর্ধেক পদ যে শূন্য, তাহা কেন্দ্রের নিয়োগ-নীতির কারণেই। অপর পক্ষে, নূতন আদালত গড়িবার ও বিচারক নিয়োগের সুযোগ পাইয়াও তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে রাজ্য সরকার। ধর্ষিত নারী ও শিশুদের দ্রুত বিচারের জন্য কেন্দ্র ২০১৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ আদালত গড়িবার পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছিল। সেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পে আটাশটি রাজ্য যোগ দিয়াছে— পশ্চিমবঙ্গ দেয় নাই।

ইহা সত্য যে, রাজ্য সরকার আপন খরচে কিছু মহিলা আদালত শুরু করিয়াছে। কিন্তু তাহার জন্য কেন্দ্রের প্রকল্পের সুযোগ লইবে না কেন রাজ্য? এ রাজ্যের সকল নির্যাতিত শিশু ও মহিলাই কি দ্রুত বিচার পাইতেছেন? কেন্দ্রীয় প্রকল্পটির সুবিধা লইলে এক হাজারের অধিক আদালত পাইত রাজ্যবাসী, নূতন আদালতগুলি চালু করিবার সিংহভাগ ব্যয় বহন করিত কেন্দ্র। রাজ্য অনুমোদন দেয় নাই বলিয়া রাজ্য ইতিমধ্যেই শতাধিক ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ শুরু করিবার সুযোগ হারাইয়াছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলের রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য রাজ্য বেশ কিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। এ ক্ষেত্রেও যদি তাহাই কারণ হয়, তবে তাহা নিন্দনীয়।

পশ্চিমবঙ্গের বিচারবিভাগীয় পরিকাঠামোর দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট মনে করাইয়াছিল যে, বাড়তি নিম্ন আদালতগুলিতে ৪২২টি কক্ষ এবং বিচারকদের জন্য ৬৩০টি আবাসগৃহ নির্মাণ করিবার কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। সে কাজে রাজ্য সরকারের ‘আলস্য এবং অনিচ্ছা’ দেখিয়াছিল শীর্ষ আদালত। সংবাদে প্রকাশ, কৌঁসুলির অভাবেও রাজ্যে বিচার বিলম্বিত হইতেছে। যথেষ্ট সরকারি আইনজীবী নাই বলিয়া লক্ষাধিক মামলার নিষ্পত্তি পিছাইতেছে। অভাব আদালতের কর্মসংস্কৃতিরও। বৎসরে একাধিক দীর্ঘ ছুটি, বার বার মামলা মুলতুবির রীতি, অনলাইনে কাজে নিম্ন আদালতের অনভ্যাস— এই সকলই বিচারে বিলম্বের কারণ। প্রায় সকল রাজ্যেই বিচারব্যবস্থায় নানা মৌলিক সমস্যা রহিয়াছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি গুরুতর। বিলম্বিত বিচারের সর্বশেষ ফল— আইনের শাসনে নাগরিকের অনাস্থা। ইহার ফলে সমাজে অস্থিরতা এবং সংঘাত বাড়িতে বাধ্য। বিচারব্যবস্থার স্তম্ভটি দুর্বল করিয়া দেশকেই দুর্বল করিতেছে গণতান্ত্রিক সরকার।

Lower Court

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}