Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
labourer

শাকান্নের জোগান

অতিমারি আসিয়া অর্থব্যবস্থাকে যে ভাবে ধ্বস্ত করিয়াছে, তাহার আঁচ সর্বাধিক লাগিয়াছে শ্রমজীবী মানুষের গায়েই।

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২১ ০৫:৪৫
Share: Save:

এক জন শ্রমিক দৈনিক ন্যূনতম কত টাকা মজুরি পাইলে তাঁহার পরিবারটি চলিতে পারে? যে দেশ নিজেকে কল্যাণরাষ্ট্র বলিয়া দাবি করে, এই প্রশ্নের উত্তর তাহার পরিচালকদের মানসে অনপনেয় অক্ষরে লেখা থাকিবে, তাহাই বিধেয়। ভারত নামক রাষ্ট্রের নায়কদের উত্তরটি জানা নাই। জানিবার তাগিদও নাই। ২০১৯ সালে শ্রমবিধি পাশ হইয়াছে। তাহাতে শ্রমিকদের ‘ফ্লোর ওয়েজ’ বা ন্যূনতম মজুরি নির্দিষ্ট করিবার কথা ছিল। দুই বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, এখনও কাজটি হয় নাই। আরও এক বার বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হইল— তাঁহারা আঁক কষিয়া জানাইবেন, শ্রমিকদের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম কত টাকা না হইলেই নহে। যত দিন না সেই প্রশ্নটির উত্তর মিলে, তত দিন ১৭৬ টাকার ন্যূনতম মজুরির হারেই সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে তাঁহাদের। সরকার কমিটিকে তিন বৎসর সময় দিয়াছে। কিন্তু, তাহার পরও যে ন্যূনতম মজুরির হারটি নির্দিষ্ট হইবে, সেই ভরসা নাই। অতীতের অভিজ্ঞতা সেই ভরসা দেয় না। ভারতীয় প্রশাসনের রঙ্গমঞ্চে যখন এই কুনাট্য অভিনীত হইতেছে, তখন বিশ্বের বহু দেশ স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া ন্যূনতম মজুরির অঙ্কটি বাড়াইয়াছে। কারণ, অতিমারি আসিয়া অর্থব্যবস্থাকে যে ভাবে ধ্বস্ত করিয়াছে, তাহার আঁচ সর্বাধিক লাগিয়াছে শ্রমজীবী মানুষের গায়েই। ভারতের ছবিটি কী রকম, তাহার প্রমাণ গত বৎসরই মিলিয়াছিল, যখন ঘরে ফিরিতে মরিয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল নামিয়াছিল রাজপথে। কাজ হারাইবার পর কয়েক দিন টিকিয়া থাকিবার সংস্থানও তাঁহাদের ছিল না। তাহার পরও কমিটি গঠনের অধিক কিছু করিতে নারাজ সরকার।

অনুপ শতপথীর নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যের একটি কমিটি ২০১৯ সালে জানাইয়াছিল, দৈনিক অন্তত ৩৭৫ টাকা মজুরি হওয়া প্রয়োজন। এক জন শ্রমিকের পরিবারে তাঁহার স্ত্রী বা স্বামী, সন্তান এবং অন্তত এক জন বয়স্ক সদস্য থাকিবেন, এবং প্রত্যেকের প্রত্যহ অন্তত ২৪০০ ক্যালরি প্রয়োজন, যাহার মধ্যে প্রোটিন ও স্নেহপদার্থ থাকিতে হইবে, এই ন্যূনতম প্রয়োজনের ভিত্তিতেই কষা হইয়াছিল অঙ্কটি। সরকার তাহা মানে নাই— দুর্জনে বলিয়া থাকে, কতিপয় শিল্পপতি এই হারে মজুরি দিতে নারাজ হওয়াতেই সুপারিশটি বাতিল হইয়া যায়। তাহার পর শুধু প্রস্তাবিত তারিখটি পাল্টাইয়াছে, শ্রমিকদের সুরাহা হয় নাই। কথা ছিল, ২০২১ সালেই ঘোষিত হইবে ন্যূনতম মজুরির অঙ্কটি। নূতন কমিটি, ও তাহার নূতন সময়সীমার সুবাদে সেই লক্ষ্যটি হাওয়ায় মিলাইয়া গেল। অতঃপর আরও একটি সুপারিশ, এবং শিল্পপতিদের স্বার্থবিরোধী হইলে তাহাও নাকচ হইবার অপেক্ষা। শ্রমিকের প্রতীক্ষা ফুরাইবার নহে।

ভারতে অন্তত চল্লিশ কোটি শ্রমিকের জীবন ন্যূনতম মজুরির হারের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই তাঁহাদের মজুরির হার দৈনিক ২০০ টাকার আশেপাশে। এই অর্থে পরিবারের ন্যূনতম পুষ্টির ব্যবস্থা করা কার্যত অসম্ভব। ব্যবস্থাটি সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থীও বটে। এবং, এই কথাটি কোনও তথাকথিত ‘দেশদ্রোহী’ রাজনীতিক বা অর্থশাস্ত্রীর নহে— কেন্দ্রীয় সরকারেরই অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এই সামাজিক ন্যায়ের প্রসঙ্গটি আসিয়াছিল। অন্যায্য মজুরির কারণে মানবসম্পদের যে বিপুল ক্ষতি হইতেছে— এই শ্রমজীবী পরিবারের সন্তানেরা আর্থিক চলমানতার প্রাথমিক শর্তটি হইতে যে ভাবে বঞ্চিত হইতেছে— সেই ক্ষতি পূরণ করা কার্যত অসম্ভব। নূতন শ্রমবিধিতে বিবিধ ভাবে শ্রমিকের স্বার্থ খণ্ডিত হইয়াছে। কিন্তু, সেই আলোচনা অন্যত্র। শ্রমবিধির দায়রায় থাকিয়াও শ্রমিকদের যেটুকু অধিকার প্রাপ্য, কমিটি গঠনের পরিচিত দীর্ঘসূত্রতার ছকে তাহাকেও বানচাল করিয়া দেওয়া এক অক্ষমণীয় অপরাধ। কেন্দ্রীয় সরকার অবলীলায় সেই কাজটি করিয়া চলিতেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

labourer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy