Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Kerala High Court

কাহার অপরাধ

অঙ্গদানের ন্যায় মহৎ ও অতি জরুরি অধিকার যে আইনের চোখে অপরাধী ব্যক্তিরও আছে, তাহা আদালতের স্বীকৃতি পাইল।

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:১৩
Share: Save:

অঙ্গদানের বিষয়টি তদারকি যাহার কাজ, জেলা স্তরের সেই কমিটিই বাঁকিয়া বসিয়াছিল। কারণ, যে ব্যক্তির কিডনি দানের কথা হইতেছে, তিনি একাধিক অপরাধে অভিযুক্ত। বিষয়টি আদালতে উঠিলে কমিটির বক্তব্য নাকচ করিয়া কেরল হাই কোর্ট বলিয়াছে, মানুষটি অপরাধী বা অভিযুক্ত হইতে পারেন, কিডনি-লিভার-হৃৎপিণ্ড অপরাধী নহে, সুতরাং ব্যক্তির অতীত অপরাধ-ইতিহাসের দোহাই পাড়িয়া তাঁহার অঙ্গদানে অসম্মতি দেওয়া যাইবে না। ব্যক্তি অপরাধীই হন বা নিরপরাধ, অঙ্গদানের ক্ষেত্রে তাহা বিবেচ্য নহে। বরং অঙ্গদানের ন্যায় মহৎ ও অতি জরুরি অধিকার যে আইনের চোখে অপরাধী ব্যক্তিরও আছে, তাহা আদালতের স্বীকৃতি পাইল।

এই সূত্র ধরিয়া অন্যতর এক প্রশ্ন ও আলোচনা উঠিয়া আসিতে পারে। আদালতের মতে, ব্যক্তি অপরাধী, কিন্তু তাঁহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা শরীরের উপর দোষ বা অপরাধ বর্তায় না। কেহ হত্যাকারী হইলেও, যে হাত দিয়া হত্যা করা হইয়াছে, সে দোষী নহে। তাহা হইলে অপরাধ কাহার? শরীরের নহে, তবে কি মনের? আত্মার? তাহাও তো নহে। সকল মহাপুরুষ বলিতেছেন, সব শাস্ত্র বলিতেছে যে, আত্মা দোষ বা গুণ, উভয়েরই ঊর্ধ্বে। গীতার সেই বিখ্যাত শ্লোক মনে পড়িতে পারে: আত্মা কাহাকেও হত্যা করে না, কাহারও দ্বারা নিহতও হয় না; সে অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য। অতএব, তাহার গায়ে তাই অপরাধপঙ্কও লাগিবার প্রশ্ন নাই। দেহেও নহে, আত্মাতেও নয়— অপরাধের আধার ও ঠিকানা তাহা হইলে কোথায়? বলা চলে যে, অপরাধ আসলে ব্যক্তির আচরণের। ব্যক্তিসত্তার অনেকাংশ নির্ধারিত হয় তাহার আচরণ দ্বারা, ব্যক্তির আচরণবিশেষই অপরাধে জড়াইয়া পড়ে, সমাজ বা পরিপার্শ্ব আস্ত মানুষটিকেই দায়ী করিলেও আইন ও আদালত সার্বিক ব্যক্তিসত্তার নহে, সেই আচরণেরই বিচার করে, তাহার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করিয়া দণ্ডবিধান করে বা বেকসুর খালাস দেয়।

অপরাধ প্রমাণিত হইলে শাস্তির ব্যবস্থা। সমাজের চোখে যাহা শাস্তি, ভারতীয় আইনশাস্ত্রের মতে তাহা সংশোধন। লোকের চোখে যাহা কয়েদখানা, বিচারব্যবস্থার কাছে তাহা সংশোধনাগার। অর্থাৎ, অপরাধীকে আগাগোড়া সমষ্টির ঘৃণার আচ্ছাদনে মুড়াইয়া কারান্তরালে নিক্ষেপই বিচারের শেষ কথা নহে, বরং এই ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হইতেছে— অপরাধীর দুষ্কৃতি করিবার মূলে যে আচরণ, তাহার সংশুদ্ধি হইতে পারে, তাহাকে সেই সুযোগটি দেওয়া হইতেছে। আবার ইহা স্রেফ সুযোগের ব্যাপার নহে, অধিকারেরও ব্যাপার। অপরাধী হইলেও তাহার কিছু অধিকার আছে, সংবিধানই সেই অধিকারের স্বীকৃতি দিয়াছে। অপরাধের শিকার যিনি হইয়াছেন, ঠিক তাঁহার মতোই, ন্যায়বিচার পাইবার অধিকার আছে অপরাধীরও। আছে সংশোধিত হইবার অধিকারও। সংশোধিত হইয়া সে সমাজের এক শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক হইয়া ফিরিয়া আসিবে, ইহাই তত্ত্ব— বাস্তবচিত্র যাহাই হউক না কেন। ভারতীয় আইনশাস্ত্র ও ব্যক্তির আচরণতত্ত্ব এখানে এক বিন্দুতে মিলিতেছে: অপরাধ ব্যক্তির কোনও স্থায়ী, অনপনেয় চিহ্ন নহে; উহা এক আচরণগত অসঙ্গতি, তাহাকে ঠিক করিবার সুযোগ ও অধিকার নাগরিকের প্রাপ্য। ভারতীয় আইনের দর্শন সেই অধিকার তত্ত্বগত ভাবে নিশ্চিত করিতেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Kerala High Court Organ Donation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy