আবার সে আসিয়াছে ফিরিয়া। শুনিয়া অবশ্য হাস্যের উদ্রেক হইতেছে না। কাবুলের পথ-ঘাট ক্রমশ নারীবর্জিত। যে যে ভাবে পারিতেছে পলাইতে তৎপর। সুতরাং প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটি কৌতুকপর্ব নহে, সুকুমার-কাণ্ডকারখানাও নহে। রক্তক্ষয়ী এই প্রত্যাবর্তন স্বাধীনতা হরণকারী, বিশেষ করিয়া নারীদের পরাধীনতার অতল গহ্বরে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিবার সূচনা। লক্ষণীয়, যে তালিবানি নির্দেশনামা জারি করা হইয়াছে তাহা সমাজ-সংসার হইতে নারীদের দৃশ্যমানতা মুছিয়া দিতে অতি তৎপর। রাস্তায় একাকী চলাচল নিষেধ। যদি পথে নামিতেই হয়, তবে বিশেষ আত্মীয় পুরুষের সঙ্গে যাইতে হইবে এবং সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া রাখা বিধেয়। বাড়ির চেহারা চরিত্র এমন করিতে হইবে, যাহাতে বাহির হইতে মেয়েদের দেখিবার উপায় না থাকে। সন্দেহ নাই, ইহা পশ্চাতের দিকে অগ্রসর হওয়া। বেগম রোকেয়া অবরোধবাসিনী গ্রন্থে মুসলমান রমণীদের দৃশ্যমানতা কী ভাবে আবৃত করা হইত তাহার বর্ণনা দিয়াছিলেন। সে গ্রন্থ নানা সত্য ঘটনার সঙ্কলন। এক ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান পুরুষ তাঁহার বেগমদের লইয়া ধর্মযাত্রায় চলিয়াছেন। রেলপথে কিছুটা যাইতে হইবে। বেগমদের মুখ ও শরীর যদি আর কেহ দেখিয়া ফেলে! তাঁহাদের বস্তাবন্দি করিয়া সার বাঁধিয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রাখা হইয়াছে। রেলগাড়ি আসিতেছে। কুলি বস্তাবন্দি রমণীদের ‘মাল’ হিসাবে গণ্য করিতেছেন। সেই সকল নারীবস্তা টানিতেছেন, লাথি মারিয়া স্থানান্তরিত করিতেছেন। ভিতরে মানবীরা স্তব্ধবাক, যন্ত্রণা সহ্য করিতেছেন নীরবে— স্বামীর আদেশে। রোকেয়া এই অবরোধবাসিনীদের বাহিরে যাইবার স্বপ্ন দেখাইতেন। সুলতানা’জ় ড্রিম লিখিয়াছিলেন ইংরেজিতে, সেই ভবিষ্য-কল্পকাহিনিতে মেয়েরা স্বাধীন ভাবে বাহিরের কাজ করিতেছেন। দুর্ভাগ্য এই, আফগানিস্তানে গত দুই দশকে মেয়েরা এমন স্বাধীন, সক্রিয় জীবনের স্বাদ পাইবার পর আবার অবরুদ্ধ হইতে বসিল। অতীতে কেবল যে মুসলমান রমণীদের আবৃত করা হইত, তাহা তো নহে, হিন্দু রমণীদেরও এই যন্ত্রণা সহিতে হইত। খুব পুরাতন কথা নহে— রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা নামক স্মৃতিকথায় যে কলিকাতার ছবি রহিয়াছে, সেখানেও অবরোধের স্পষ্ট চিত্র। মেয়েদের গঙ্গাস্নানের জন্য বাড়ির উঠানে পাল্কি আসিয়াছে। গঙ্গাস্নানেচ্ছু রমণীরা পাল্কিতে উঠিলেন। তাহার পর সেই পাল্কিবন্দি রমণীকে পাল্কি-সহ গঙ্গায় চুবাইয়া আনা হইল। পাল্কি স্নান করিয়াছে, অর্থাৎ পাল্কির অভ্যন্তরস্থ রমণীরও স্নান
সমাপন হইয়াছে।
কেন রমণীদের এই ভাবে ঢাকিয়া রাখা জরুরি বলিয়া বোধ হইত? মনে রাখিতে হইবে, যে-কোনও ধর্মীয় বিধিচালিত সমাজ কিংবা রাষ্ট্র যখন মেয়েদের নির্বিশেষে ঢাকিয়া রাখিতে চাহে, তখন আদতে মেয়েদের ব্যক্তি-অধিকার অস্বীকার করাই তাহার লক্ষ্য। পাল্কি-আবৃত, বোরখা-পরিহিত মেয়েদের দূর বা নিকট হইতে দেখিয়া আলাদা করিয়া চিনিবার উপায় নাই— তাঁহাদের ব্যক্তিরূপ সেখানে অস্বীকৃত। নির্বিশেষ একটি অবয়ব হিসাবে তাঁহাদের তুলিয়া ধরা হইতেছে। সেই অবয়বের দৃশ্যমানতার অধিকার যে কেবল ঢাকা পড়িল তাহা নহে, কথা বলিবার অধিকারও অপহৃত হইল। কথা বলিবার অর্থ সংযোগ স্থাপন, মতামত প্রদান ও প্রয়োজনে বিরুদ্ধকথন। এই সকল অধিকার হরণ করিয়া, মেয়েদের কথা বলিবার অধিকার বিনাশ করিয়া, বর্বর পিতৃতান্ত্রিকতা কায়েম হইল। মেয়েরা অতঃপর নির্বিচারে পুরুষের যৌনচাহিদা মিটাইবার উপকরণ রূপে ব্যবহৃত হইবেন।
মুক্তির উপায় অজানা। কারণ এই লড়াই তো কেবল সমাজব্যবস্থার সহিত নহে, রাষ্ট্রব্যবস্থার সহিত। ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান সমাজে যে সংস্কার সাধন সম্ভব হইয়াছিল তাহা সমাজব্যবস্থার সহিত লড়াইয়ের ফল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর নারী-স্বাধীনতার প্রসঙ্গে যে লড়াই করিয়াছিলেন, তাহা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই— বাস্তবিক রাষ্ট্র তখন সংস্কারে সহায়তাই করিয়াছিল। রোকেয়া বা ইসমত চুঘতাই যখন মুসলমান রমণীদের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলিয়াছেন, তখন তাঁহাদের সেই বিরুদ্ধকথনও সমাজের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নহে। যখন ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নারী-স্বাধীনতা হরণ করে, তখন পথ অধিকতর দুস্তর। স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা অপরের মতামতের কিংবা শোভন-অশোভনের তোয়াক্কা করে না। সে রাষ্ট্রযন্ত্র অস্ত্রের মাধ্যমে বাক্যালাপ করে। সেই কণ্টকাকীর্ণ পথে অগ্রসর হওয়া সহজ কাজ নহে।
যৎকিঞ্চিৎ
বিজেপি সাংসদ জানালেন, রবীন্দ্রনাথ কালো ছিলেন বলে তাঁর মা তাঁকে মোটে কোলে নিতেন না— তবুও তিনি ভারতের হয়ে বিশ্বজয় করলেন। তা সে যতই কালো হোক, নোবেল বলে জানে গাঁয়ের লোক। সাংসদবাবুর সাদা মনে কাদা নেই। তাঁর মনের বিশ্বটি যে মালমশলায় নির্মিত, তার বর্ণে বর্ণে বিদ্বেষ— সেই মনের সহজপাঠ-এ লেখা, কালো মানেই অযোগ্য। নোবেল কমিটিও কি তেমনই মনে করত? প্রথম কৃষ্ণাঙ্গকে নোবেল দিতে কিন্তু সময় লেগেছিল ঝাড়া ৫০ বছর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy