গণতন্ত্রে নির্বাচন যে অতি জরুরি বস্তু, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনও সংশয় থাকিবার কথা নহে। গত মার্চ-এপ্রিলে কোভিডের দ্বিতীয় প্রবাহ যখন প্রত্যহ প্রবলতর হইয়া উঠিতেছিল, তখনও কমিশন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনপ্রক্রিয়া স্থগিত রাখে নাই— নির্বাচন নিতান্ত জরুরি বলিয়াই নহে কি? অতিমারি শক্তি বাড়াইয়াছে, কিন্তু প্রশাসনিক যন্ত্র ভয় পায় নাই। রাজ্য জুড়িয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা; নির্বাচন আধিকারিকরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছাইয়াছেন; বিশাল হইতে বিশালতর জনসভার আয়োজন হইয়াছে, রাজ্যের আনাচকানাচ চষিয়া ফেলিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী-সহ তাবড় নেতারা। বিধানসভা নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনই যে আসনগুলিতে কোনও কারণে ভোট হয় নাই, বা যে আসনগুলিতে উপনির্বাচন প্রয়োজন, সেখানেও ভোট হওয়া সমান জরুরি। এই কয়টি আসনের ফলাফলে শাসনক্ষমতা পাল্টাইবে না। কিন্তু, গণতন্ত্রে নির্বাচনের প্রধানতম গুরুত্ব হইল, তাহা নাগরিকের জনপ্রতিনিধি চয়নের অধিকার নিশ্চিত করে; গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একক নাগরিকের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয়। যে কেন্দ্রগুলি ভোটের অপেক্ষায় রহিয়াছে, সেখানকার নাগরিকদের এই অধিকাররক্ষার দায়িত্ব কি কমিশন অস্বীকার করিতে পারে? এই কেন্দ্রগুলিতে বিধায়ক নাই— গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের অধিকার হইতেও কি মানুষকে বঞ্চিত করিয়া যাওয়া চলে?
রাজ্য সরকার জানাইতেছে যে, তাহারা বকেয়া নির্বাচন ও উপনির্বাচনগুলি সারিয়া লইতে প্রস্তুত। ঘটনা হইল, এখনও কোভিড সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে— নির্বাচন যদি করিতেই হয়, তবে তাহা এখনই সারিয়া লওয়া বিধেয়। নির্বাচন কমিশন ইঙ্গিত দিয়াছে যে, দুর্গাপূজার পূর্বেই হয়তো ভোটপর্ব সারিয়া লওয়া হইবে। আর কোনও কারণে যদি না-ও হয়, তবু তাহাদের মার্চ-এপ্রিলের ভূমিকার খাতিরেই কমিশনের কর্তব্য নির্বাচন আয়োজন করা। কমিশনের ন্যায় প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা বজায় থাকা গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন। স্বশাসিত কমিশন কোনও অবস্থাতেই রাজনৈতিক চাপের নিকট নতিস্বীকার করিয়া ন্যায্যতার পথ পরিত্যাগ করিবে না— এই কথাটি হইতে কোনও অবস্থাতেই সাধারণ মানুষের বিশ্বাস সরিয়া যাইতে দেওয়া যায় না। কয়েক দশকের ব্যবধানেও টি এন শেষনের স্মৃতি জনচিত্তে অমলিন, কারণ তাঁহাকে দেখিয়া মানুষের বিশ্বাস হইয়াছিল যে, মহামহিম রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব। গণতন্ত্রে এই বিশ্বাসটি অমূল্য।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা রক্ষা করিবার কাজটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হইয়াছে, কারণ এই আমলের অভিজ্ঞান হইল বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নগ্ন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা। মার্চ-এপ্রিলে অতিমারির বিপদ উপেক্ষা করিয়াও পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন করিতেই হইল কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর কেহ বিজেপির রাজনৈতিক তাগিদে খুঁজিয়া পাইতে পারেন। তখন বিজেপি বঙ্গবিজয়ের প্রশ্নে ঘোর আত্মবিশ্বাসী ছিল। এখন বিজেপির নেতারা কোভিডের অজুহাতে উপনির্বাচন পিছাইতে মরিয়া— বোঝা যায়, তাহাও একটি ক্ষুদ্রতর রাজনৈতিক স্বার্থে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপনির্বাচনে জিতিয়া আসিতে না পারিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী পদ হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে হইবে— এমন একটি সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনাটিকে বাস্তবায়িত করিবার জন্যই কি উপনির্বাচন না করিতে দেওয়ার এই অতি আগ্রহ? উহা নিতান্তই অপরকে উত্ত্যক্ত করিয়া আনন্দ পাইবার নিম্নমানের রাজনৈতিক ছক। নির্বাচন কমিশন যে এই ক্ষুদ্রতার সাধনায় বিজেপির দোসর নহে— এই কথাটি প্রমাণ করিবার দায় কমিশনের উপরই বর্তায়। নিজেদের স্বার্থেই তাহাদের প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy