আবাহনেও বিতর্কের সুযোগ ছিল না, বিসর্জনেও থাকিল না। লোকসভায় তিন মিনিট, আর রাজ্যসভায় নয় মিনিট, সংসদের দুই ভবনে কৃষি আইন বিলুপ্তির বিল পাশ করাইয়া লইতে কেন্দ্রীয় শাসকরা ব্যয় করিলেন সাকুল্যে বারো মিনিট। কেন, তাহার একটি ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, বিরোধীরা তো এত দিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করিবারই দাবি জানাইতেছিলেন; সরকার যখন সেই কাজটিই করিতেছে, তখন আর আলোচনার কী প্রয়োজন? গণতন্ত্রের দেবতা কথাটি শুনিয়া মুচকি হাসিবেন। দিন দশেক পূর্বে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে আলোচনার কোনও বিকল্প নাই। বস্তুত, যে দিন কৃষিমন্ত্রী তোমর আলোচনা বা প্রশ্নোত্তরকে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করিলেন, সে দিনই প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, সংসদের অধিবেশনে তাঁহারা যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত। এই কথাটিও যে সত্য নহে, তাহার প্রমাণ রাজ্যসভার কংগ্রেস সাংসদ কে সি বেণুগোপাল দিবেন— কেন্দ্রীয় সরকার অনাবাসী ভারতীয়দের কৃষি বিক্ষোভে মদত দিতে বারণ করিয়া দিয়াছিল কি না, বিদেশমন্ত্রীর প্রতি বেণুগোপালের এই প্রশ্নটি সংসদে আলোচনার জন্য নির্বাচিত হইয়াও বাতিল হইয়া গিয়াছে। কিন্তু, তাহা একটি উদাহরণমাত্র। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আলোচনা, প্রশ্নোত্তরের গুরুত্ব যে কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকার করে না, গত সাড়ে সাত বৎসরে তাহা সেই প্রদীপের শিখার ন্যায় স্পষ্ট। তাঁহাদের নিকট সত্য শুধু হার-জিত। প্রধানমন্ত্রী পরাজয় স্বীকার করিয়া লইবার পরও আর আলোচনার কী থাকিতে পারে, তোমরের মন্তব্যে এই বিস্ময়টি প্রকট।
আলোচনার অবশ্য অনেক কিছুই আছে। প্রথমত, দেশবাসীর জানা প্রয়োজন যে, কৃষি আইন হইতে প্রধানমন্ত্রী পিছু হটিলেন কেন? নেহাতই পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটের তাগিদে; না কি তিনি বুঝিয়াছেন যে, শুধুমাত্র আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করিয়া আইন চাপাইয়া দেওয়া যায় না? গণতন্ত্রে আলোচনার মাহাত্ম্য যে তাঁহারা অনুধাবন করিতে পারেন নাই, তাহা স্পষ্ট— কিন্তু, নেহাত কৌশলগত কারণেই তাঁহারা ভবিষ্যতে লোকসভা-রাজ্যসভাকে পাশ কাটাইবার প্রবণতা ত্যাগ করিবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরও বকেয়াই থাকিল। কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের প্রশ্নটিকেও কি তাঁহারা স্নানের জলের সহিত শিশুটিকে ফেলিবার মতোই বিসর্জন দিলেন? আলোচনা ছাড়াই শ্রমবিধির ন্যায় অন্য যে আইনগুলি তাঁহারা তৈরি করিয়া লইয়াছেন, জাতীয় শিক্ষা নীতির ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত লইয়াছেন, সেগুলির পরিণতিই বা কী হইবে, দেশবাসীকে সেই প্রশ্নের উত্তরও দিতে হইত। নরেন্দ্র তোমর আলোচনার অসারতা সম্পর্কে কথাটি ঠিক বলেন নাই।
কিন্তু, শুধু সরকারপক্ষ বলিলেই হইত না, আলোচনার প্রয়োজন আরও বেশি ছিল বিরোধীদের কথা শুনিবার জন্য। কৃষি আইন বাতিল হওয়া জেতা-হারার প্রশ্ন নহে— বিরোধীরা ‘জিতিয়াছেন’ বলিয়াই তাঁহাদের আর কথা বলিবার প্রয়োজন নাই, এই কথাটি সম্পূর্ণ ভুল ও অগণতান্ত্রিক— কেন একটি আইন তৈরি করিয়াও শেষ অবধি তাহা হইতে সরকারকে পিছাইয়া আসিতে হইল, বিরোধীদের সেই ব্যাখ্যা করিতে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। সেই ব্যাখ্যা হইতেই শাসকপক্ষ নিজেদের ভুলগুলি চিহ্নিত করিতে পারিত, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হইতে পারিত। গণতন্ত্র মানে যে শুধু সংখ্যার জোরে জয়লাভ নহে, গণতন্ত্র যে মূলত শুশ্রূষা— শুনিবার ইচ্ছা— নরেন্দ্র মোদীর সরকার এই কথাটি বুঝিতে নারাজ। সংশয় হয়, কৃষি আইনের দ্বন্দ্বে ‘পরাজয়’ তাঁহাদের বিনয় শিখাইল না, গণতান্ত্রিকতা শিখাইল না, শুধুমাত্র পরের বারের জন্য দাঁত-নখ তীক্ষ্ণতর করিবার শিক্ষা দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy