Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Democracy

আর রাষ্ট্রের দায়?

ভারতীয় গণতন্ত্রের সমকালীন বিপন্নতার একটি বড় কারণ ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ক্ষমতাবানের মুখের উপর প্রতিবাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সত্যভাষণের ঘাটতি।

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:০১
Share: Save:

সত্য একই সঙ্গে গণতন্ত্রের হাতিয়ার এবং তাহার বর্ম। বাঁচিবার জন্য গণতন্ত্রের সত্যকে প্রয়োজন। এই কারণেই সত্যকথন নাগরিকের অধিকার এবং তাহার কর্তব্য।— সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় কথাগুলি বলিয়াছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। বিচারক, রাষ্ট্রদূত এবং অন্য নানা ভূমিকায় স্বনামধন্য এম সি চাগলার স্মরণে তাঁহার প্রদত্ত ভাষণটির শিরোনাম: ‘স্পিকিং ট্রুথ টু পাওয়ার’, অর্থাৎ ক্ষমতাবানের মুখের উপর সত্য কথা বলা। শিরোনামটি তাৎপর্যপূর্ণ। বিচারপতি চন্দ্রচূড় ইতিহাস, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভান্ডার হইতে বিবিধ মণিমুক্তা আহরণ করিয়া সেই তাৎপর্য বুঝাইয়া দিয়াছেন। তাঁহার ভাষণটি গভীর সুচিন্তার ফল হিসাবে উপাদেয়, নূতন চিন্তার রসদ হিসাবেও মূল্যবান। তিনি আপন বক্তব্যের উপক্রমণিকায় এক দিকে যেমন বলিয়াছেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকদের কথিত ‘পারেসিয়া’ বা সমস্ত সত্য অকপটে বলিবার নীতির কথা, অন্য দিকে তেমনই উল্লেখ করিয়াছেন গাঁধীর সত্যাগ্রহের ধারণা। উভয় ক্ষেত্রেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি ক্ষমতা সংক্রান্ত। ক্ষমতাবান যখন অন্যায় করে বা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, তখন তাহাকে এবং তাহার বিরুদ্ধে সত্য বলিবার অধিকার ও কর্তব্য যে একটি ন্যায্য ব্যবস্থার, বিশেষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অপরিহার্য শর্ত তথা মাপকাঠি, সেই কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া বিচারপতি চন্দ্রচূড় বড় কাজ করিয়াছেন।

নাগরিকরা এই কথাটি ভুলিলে বা তাহাকে অবহেলা করিলে, বিশেষত যে নাগরিকরা সমাজের বিবিধ পরিসরে কিছু প্রভাব বা সামর্থ্যের অধিকারী তাঁহারা আপন সত্যবদ্ধ কর্তব্য পালন না করিলে গণতন্ত্রের বিপদ বাড়িতে বাধ্য। একটি নির্দিষ্ট এবং সমকালীন দৃষ্টান্ত হিসাবে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সাম্প্রতিক ভূমিকার কথা স্মরণীয়। নরেন্দ্র মোদী তথা সঙ্ঘ পরিবারের শাসনের কালে বিরোধী রাজনীতির শিবিরে অনেক দল এবং তাহাদের নায়কনায়িকারাই গণতন্ত্রের প্রতি আপন কর্তব্য সম্যক ভাবে পালন করেন নাই, তাঁহাদের এই ‘গণতান্ত্রিক ঘাটতি’ শাসকদের আধিপত্যবাদী যথেচ্ছাচারের প্রকোপ বাড়াইয়া তুলিয়াছে। কেবল বিরোধী দল নহে, গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসাবে পরিচিত অন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ অল্পবিস্তর প্রযোজ্য। অন্য অনেক দেশের মতোই, ভারতীয় গণতন্ত্রের সমকালীন বিপন্নতার একটি বড় কারণ ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ক্ষমতাবানের মুখের উপর প্রতিবাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সত্যভাষণের ঘাটতি। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের অভিমত কেবল গুরুত্বপূর্ণ নহে, অতীব প্রাসঙ্গিক।

প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বলিয়াই তাঁহার এই অভিমতের সূত্র ধরিয়া একটি প্রশ্নও উঠিতে পারে। সত্যের প্রতি ক্ষমতার অধীশ্বরদের আগ্রহের প্রশ্ন। সত্যভাষণের অনুকূল পরিবেশ সরবরাহ করা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাঁহাদের একটি প্রাথমিক কর্তব্য, মহামান্য বিচারপতি সেই কথাটি স্পষ্ট করিয়া বলিলে ভাল হইত না কি? যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে দাঁড়াইয়া তিনি এই বক্তৃতা দিয়াছেন, সেখানে ক্ষমতাবানের দায়িত্বের কথা আপন ভাষণের অন্দরে নিহিত রাখা হয়তো যথেষ্ট নহে, ক্ষমতার মুখের উপর সেই দায়িত্বের কথা বলিয়া দেওয়া জরুরি। কোনও কোনও ভূতপূর্ব বিচারপতি-সহ কিছু নাগরিক সম্প্রতি তেমন স্পষ্টভাষী হইয়াছেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সমালোচনা প্রখরতর হইলে সেই ধারা আরও স্রোতস্বিনী হইত। তাহাতে বর্তমান শাসকরা কতটুকু আত্মসংশোধন করিতেন, বলা শক্ত। সমালোচনা হজম করিয়া আপন অনাচারে একনিষ্ঠ থাকিবার আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁহাদের অধিগত। কিন্তু তাহার পরেও সমালোচনার প্রয়োজন ফুরায় না। ক্ষমতাবানকে অপ্রিয় সত্য কথা শুনাইবার যে কর্তব্য বিচারপতি চন্দ্রচূড় নাগরিকদের স্মরণ করাইয়াছেন, তাহা পালনের জন্য ন্যূনতম কিছু রক্ষাকবচ নাগরিকেরও প্রাপ্য। এই দেশে সেই প্রাপ্য হইতে বহু ক্ষেত্রেই তাঁহারা বঞ্চিত। মোদীতন্ত্রে সেই বঞ্চনা অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে। সুপ্রিম কোর্ট তথা বিচারব্যবস্থা কার্যত অ-সত্যপরায়ণ রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নাগরিকের একমাত্র সহায় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সেই সহায়তাও ষোলো আনা কার্যকর, এই দাবি করা কঠিন। কেবল বিচারবিভাগের সামর্থ্যের ঘাটতিই নহে, সামর্থ্যের সদ্ব্যবহারে যথেষ্ট আগ্রহের অভাব আছে বলিয়াও সংশয় দেখা দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি চন্দ্রচূড় রাষ্ট্রশক্তিকে সত্যের প্রতি ভয়াবহ অশ্রদ্ধার জন্য কঠোর তিরস্কার করিলে তাঁহার সারগর্ভ ভাষণটি গণতন্ত্রের হাতিয়ার হিসাবে ক্ষুরধার হইতে পারিত।

যৎকিঞ্চিৎ

উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার স্পিকার মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে রাখী সবন্তের তুলনা করেছেন। বলেছেন, জামাকাপড় খুলে ফেললেই মহান হওয়া যায় না। গাঁধী বলতে নাগপুরের পোড়োরা যে শুধু বহিরঙ্গকেই বুঝবেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। প্রশ্ন হল, তাঁরা এমন ব্যাকডেটেড কেন? অন্য খবর নাহয় রাখেন না, কিন্তু বিরলবস্ত্র সুন্দরীর উদাহরণ ভাবতে গিয়েও এমন এক জনের কথা মনে পড়ল, যাঁর কথা আর ‘কেহ তো বলে না’? এই প্রজন্ম কাদের কথা বলছে, সেই খোঁজটুকু তো রাখতে হবে, না কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Democracy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy