Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Electrocution

মৃত্যুস্পৃষ্ট

কোথাও বাবা-মা-পুত্র’সহ গোটা পরিবার, কোথাও দুই বালিকা, কোথাও কাজফেরত যুবকের জলে ভাসমান মৃতদেহগুলি যেন মহানাগরিক আধুনিকতার মূর্তিমান ব্যর্থতা।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:১১
Share: Save:

ইহাকেই কি বলে মহানগর? এই প্রস্তুতিহীন, নির্লিপ্ত, অসংবেদী শহর, প্রতি বৎসর বর্ষায় যে তাহার নাগরিকদের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া মরিবার পথ খুলিয়া রাখে? প্রবল বৃষ্টিতে শহর ডুবিয়া, ঘরেও জল ঢুকিয়াছে? বর্ষায় তো বৃষ্টি হইবেই! বহু অঞ্চল, রাস্তাঘাট এবং সেই সঙ্গে বৈদ্যুতিক বাতিস্তম্ভ ও বিদ্যুতের জয়েন্ট বক্সগুলি পর্যন্ত জলে ডুবিয়া আছে? বাহির না হইলেই, স্পর্শ না করিলেই চলে!— ইহাই তাহার অন্তর্গত মনোভাব। রহড়া, দমদম কিংবা রাজভবন সংলগ্ন খাস কলিকাতা— কোথাও বাবা-মা-পুত্র’সহ গোটা পরিবার, কোথাও দুই বালিকা, কোথাও কাজফেরত যুবকের জলে ভাসমান মৃতদেহগুলি যেন মহানাগরিক আধুনিকতার মূর্তিমান ব্যর্থতা। প্রাণ গিয়াছে, প্রশ্নগুলি থাকিয়া যায়: একুশ শতকের কলিকাতায় মৃত্যু এত সহজ ও সস্তা? কেবল উন্মুক্ত বা জলমগ্ন অথচ বিদ্যুৎ সংযোগযুক্ত বিদ্যুৎস্তম্ভ, খোলা জয়েন্ট বক্স থাকিলেই যথেষ্ট?

বর্ষা আসিয়াছে, বর্ষা যাইবে। পুরভোটও আসিবে, যাইবে। কিন্তু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া চোদ্দোটি মৃত্যুর পরেও, প্রতি বৎসর একই করুণ ট্র্যাজেডির পুনরাবর্তনের পরেও কি এই বোধের উদয় হইবে না, একটি আধুনিক সভ্য নগরে খোলা, তার বাহির হইয়া থাকা বিদ্যুৎস্তম্ভ থাকিতে নাই, বর্ষায় রাস্তার জমা জলে বিদ্যুতের ছেঁড়া তার পড়িয়া থাকা অপরাধের শামিল, আর একেবারে গোড়ার কথা: একুশ শতকের এক মহানগরে ওভারহেড তার থাকিবেই বা কেন? কেন শহরের অফিসপাড়ায়, পুরাতন ও জনবহুল বাণিজ্য-এলাকাগুলিতে বিপজ্জনক তারের জঞ্জাল সম্ভাব্য মৃত্যুফাঁদ হইয়া ঝুলিয়া থাকিবে, ওভারহেড তারে জ্যাকেট পরানো বাধ্যতামূলক হইলেও স্থানে স্থানে তাহার অনুপস্থিতি চোখে পড়িবে? পূর্ত-প্রকৌশলের বিবর্তনকে স্বাগত জানাইয়া বিশ্বের মহানগরগুলি যেখানে ওভারহেড তার বিসর্জন দিয়াছে, কলিকাতায় তার ব্যত্যয় হইবে কোন যুক্তিতে? শুধু বিদ্যুতেরই নহে, টিভি ও আন্তর্জাল সংযোগের তারও শহরময়, বিদ্যুতের তার, স্তম্ভ বা পরিকাঠামো আশ্রয় করিয়াই তাহারাও পল্লবিত ও বিস্তৃত। সেইগুলিই বা কেন পাতালপ্রবিষ্ট হইবে না? ব্যবসা করিতেছ, পরিষেবা দিতেছ ভাল কথা, ওভারহেডের বদলে আন্ডারগ্রাউন্ড তারের ব্যবস্থা করা উন্নততর পরিষেবারই অঙ্গ, সংস্থাগুলিকে এই কথা কে বুঝাইবে?

নাগরিকমৃত্যুর পরে বর্ষায় বাতিস্তম্ভের ত্রুটি সংশোধনে মন দিয়াছে পুরসভা। লোহার ঢাকনার পরিবর্তে প্লাস্টিকের ঢাকনা বসিতেছে, বিদ্যুতের জয়েন্ট বক্সের পর্যবেক্ষণ হইতেছে। এই সবই ঠিক, তবে যথেষ্ট কি না, তাহাই দেখিবার। জলমগ্ন অঞ্চলগুলিতে সাময়িক ভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখিবার নির্দেশ দেয় পুরসভা, বিদ্যুৎ সংস্থা সেই মতো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়। তবু বিদ্যুৎস্তম্ভ স্পর্শের জেরে মৃত্যুর ঘটনা চলিতেই থাকে। জল ও বিদ্যুৎ, এই দুইটিই নাগরিকের অতি জরুরি পুর-অধিকার। জলযন্ত্রণা ও বিদ্যুতের বিপদ, নাগরিকের দুই সমস্যার সমাধানে পুর-প্রশাসনকে তৎপর হইতে হইবে। সুষ্ঠু ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সেই তৎপরতার অত্যাবশ্যক অঙ্গ। নাগরিকের মৃত্যুর মূল্যে নহে, মৃত্যু রুখিতে আগেভাগে সেই ব্যবস্থা করা দরকার। মহানগর ছবির শুরুতে ট্রামের তার কলিকাতার পরিচায়ক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, এই সময়ের কোনও চলচ্চিত্রে জমা জলে বিদ্যুতের ছেঁড়া তার মহানাগরিক অভিজ্ঞান হইয়া উঠিলে ভাল হইবে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Electrocution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy