আদেশ নহে, পরামর্শ। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব টেকনোলজি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর ন্যায় প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় সরকার পরামর্শ দিয়াছে, পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ হইতে ইংরেজির পাশাপাশি ‘ভারতীয় ভাষা’-তেও পাঠদান করা হউক। এক্ষণে ‘ভারতীয় ভাষা’ কথাটি আলঙ্কারিক মাত্র, প্রকৃত সরকারি পরামর্শ হিন্দি ভাষায় পাঠদান করিবার। নাগপুর-কল্পিত ভারতে ‘এক ভাষা’ হিসাবে হিন্দিরই অস্তিত্ব; বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটও হিন্দি বলয়েই। কাজেই, দেশের উৎকৃষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে হিন্দিতে পাঠদানের মাধ্যমে হিন্দিভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, এবং ভিন্নভাষীদের কোণঠাসা করিবার চেষ্টা নাগপুরের গৈরিক জাতীয়তাবাদের আদর্শের সমানুবর্তী। এবং, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে হিন্দিতে পাঠদান চালু করিবার জন্য মুখ ফুটিয়া সেই কথা বলিবারও প্রয়োজন নাই। বহুভাষাভাষী দেশের সকল ছাত্রছাত্রীর মাতৃভাষায় পাঠদান যে হেতু বাস্তবিক অসম্ভব, সুতরাং ‘জাতীয়’ এবং ‘সর্বভারতীয়’ ভাষা হিসাবে হিন্দিই মাতৃভাষার বিকল্প— একেবারে সরল যুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার স্বার্থেই এই যুক্তির মূলোচ্ছেদ করা বিধেয়। হিন্দি যে ভারতের ‘জাতীয় ভাষা’ নহে, এমনকি ‘সর্বভারতীয় ভাষা’ও নহে— দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রথম বা দ্বিতীয় ভাষা যে হিন্দি নহে— এই কথাগুলি বলিয়া চলিতে হইবে। ভারতীয় ভাষাকে গুরুত্বদানের মোড়কে হিন্দির আগ্রাসন বিষয়ে সচেতন থাকা অতি জরুরি।
কিন্তু, যদি সত্যই এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে সকল ভারতীয় ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহাও কি গ্রহণযোগ্য? বিদ্যার্জনের পথে কোনও বিশেষ ভাষায় স্বচ্ছন্দ না হওয়া বাধা হইতে পারে না— ইংরেজিতে দক্ষ না হইয়াও কেহ গণিত বা দর্শন, অর্থশাস্ত্র বা ইতিহাসের চর্চা যেন চালাইয়া যাইতে পারেন, তেমন ব্যবস্থা হওয়াই বিধেয়। কিন্তু, যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকার ভারতীয় ভাষা চালাইতে উদ্গ্রীব, সেইগুলির শিক্ষা মূলত পেশাদার— তাহার মূল অভীষ্ট জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা নহে, চাকুরি বা ব্যবসায় কুশলতা অর্জন। এ-হেন ক্ষেত্রে ইংরেজির জ্ঞান অপরিহার্য, কারণ চাকুরির বৈশ্বিক বাজারের অদ্বিতীয় ভাষা বর্তমানে ইংরেজিই। যে দেশগুলি একদা ইংরেজিকে পরিহার করিয়া চলিত, সেই জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানও ক্রমে উচ্চশিক্ষার ভাষা হিসাবে ইংরেজিকেই স্বীকৃতি দিতেছে। চিন, কোরিয়া ইত্যাদি দেশ ছাত্রছাত্রীদের প্রবল গুরুত্ব সহকারে ইংরেজি শিখাইতেছে। তাহা এই ভাষাটির প্রতি আন্তরিক টানের কারণে নহে, ভাষাটির ব্যবহারিক গুরুত্বকে স্বীকার করিয়া। হিন্দি বলয়ের ভোটের টানে ভারতের অগ্রগণ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে যদি বিপরীত অভিমুখে হাঁটিতে বাধ্য করা হয়, তবে তাহা ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থের পরিপন্থী হইবে।
তাহা হইলে কি পেশাদারি শিক্ষার জগতে প্রবেশের পূর্বশর্ত ইংরেজির জ্ঞান? মাতৃভাষায় প্রবেশিকা পরীক্ষা গ্রহণের যে দাবি বিশেষত দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি লাগাতার করিয়া চলিয়াছে, তাহা কি ভিত্তিহীন? এমন দাবি কেহ করিবেন না। প্রবেশিকা পরীক্ষা মাতৃভাষায় হইতেই পারে, কিন্তু তাহার পর ইংরেজি শিখিয়া লওয়া ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য; তাহাদের শিখাইয়া লওয়া প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। তাহার জন্য বিশেষ ক্লাস, বিশেষ প্রশিক্ষণ, আলাদা যত্ন— যাহা প্রয়োজন, তাহারই ব্যবস্থা করিতে হইবে। কিন্তু, বৈশ্বিক চাকুরির বাজারে যোগ দিতে হইলে ইংরেজির গুরুত্ব অস্বীকার করা চলিবে না। ভারতীয় যুব সম্প্রদায়কে বিশ্বসভায় যোগ দিবার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করিতে হইবে। মাতৃভাষাকে ভালবাসার সহিত দুনিয়ার ভাষায় দক্ষ হইয়া উঠিবার মধ্যে যে কোনও বিরোধ নাই, তাহা ভুলিলে চলিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy