জি-২০ সম্মেলন। —ফাইল চিত্র।
এ বারের জি২০ সম্মেলনের ইতি টানার সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উচ্চারণ করলেন, ‘স্বস্তি অস্তু বিশ্বে’। শান্তি আসুক বিশ্বে। অনুমান করা যায়, ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা-র হাতে আগামী সভাপতির দায়িত্বভার তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তিতে তিনিও। সম্মেলনের পূর্বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টির পাশ কাটিয়ে জি২০ সদস্যদের যৌথ বিবৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে যে উৎকণ্ঠার আবহ তৈরি হয়েছিল, তা এখন অতীত। বিবৃতি তো পাওয়া গিয়েছেই, সঙ্গে পশ্চিমি শক্তিসমূহ ও রাশিয়া— দু’তরফকেই কূটনৈতিক ভাবে সামাল, কিংবা আপাত-সামাল, দিতে সক্ষম হয়েছে ভারত। প্রসঙ্গত, গত নভেম্বরে বালি সম্মেলনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যতটা কড়া বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল, নয়াদিল্লিতে তার সুর তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই নরম। সেই কারণে রাশিয়া তো বটেই, বিরোধিতা করেনি চিনও। ফলে জি২০’র প্রেসিডেন্ট পদটি ব্যবহার করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে আন্তর্জাতিক ‘ইমেজ’ তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই লক্ষ্যে এক অর্থে তিনি সফল। বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতারাও সম্মেলনের পরে তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
তবে, নয়াদিল্লির সাফল্যের কথা আন্তর্জাতিক এবং অন্দর-মহলে সরবে বিজ্ঞাপিত হলেও, কিছু প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। যেমন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমের প্রবল উষ্মা থাকা সত্ত্বেও ভারতের উদ্যোগে যে ঐকমত্য গড়া সম্ভব হয়ে থেকে থাকে, তার ফল কী দাঁড়াবে? গত কয়েক বছরে চিনের পশ্চিম-বিরোধী বিশ্ব গড়ে তোলার চেষ্টা একটা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির কাছে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রটির আধিপত্য হ্রাস করতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত ছাড়া অন্য বিকল্প নেই তাদের হাতে। ফলে ভারতের অবস্থান তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাশিয়া বিষয়ে ভারতের অবস্থান মেনে নেওয়াও তাদের কাছে কঠিন। অন্য দিকে, এই বৈঠকে পরিবেশ পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির ক্ষমতা তিন গুণ বাড়াতে সম্মত হলেও, কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনও লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু নির্ধারণ করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, জ্বালানির ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে কয়লার ব্যবহার কমানো বিষয়ে জোর দেওয়া হলেও অপরিশোধিত তেলের ব্যবহার কমানোর কোনও লক্ষ্যমাত্রা উল্লিখিত হয়নি, যা রাশিয়া এবং সৌদি আরবের ক্ষেত্রে স্বস্তির বিষয়। বিশ্বের আশি শতাংশ কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে দায়ী অধিকাংশ জি২০’র সদস্যই। আর একটি মুখ্য বিষয় ছিল অতিমারি ও যুদ্ধের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলির ঋণের সমস্যা। বিবৃতিতে এই বৈশ্বিক সমস্যাটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও চিনের কারণে যে বহু দেশ ঋণের ফাঁদে, সে বিষয়ে কোনও উল্লেখ নেই। নেই দেশগুলিকে ঋণমুক্ত করার উপযুক্ত পদক্ষেপের কথাও। সুতরাং ১৯৯৯ সালে মূলত একটি আর্থিক গোষ্ঠী হিসাবে তৈরি এই জি২০’র প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রাগুলির কোনওটিই আদৌ পূরণ হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রশ্ন আরও। আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দৌলতে দেশের বদলে শীর্ষনেতার ভাবমূর্তি প্রসারের চেষ্টাটি সমস্যাজনক নয় কি? বিজেপির অন্দরে মোদীর জি২০ সাফল্য নিয়ে আস্ফালন চলছেই, তার উপর বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করও যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী-বন্দনার সুর চড়িয়েছেন, তা বিশেষ দৃষ্টিকটু। শোনা যাচ্ছে, এই ‘কৃতিত্ব’কে কাজে লাগাতে নাকি জাতীয় নির্বাচনও কিছু আগে আয়োজিত হবে। অথচ জি-২০ বৈঠক একটি নিয়মিত আন্তর্জাতিক বৈঠক, এক এক বার এক এক দেশ তার দায়িত্ব পায়। এ বারের দায়িত্বপালনের মধ্যে ভারতেরও বিশেষ কৃতিত্ব নেই, নরেন্দ্র মোদীর তো নেই-ই। দেশের হাজারো ঘরোয়া সমস্যাই শেষ অবধি জাতীয় ভোটের মাঠে জরুরি বিষয় হয়ে ওঠা উচিত। কূটনীতি আর রাজনীতির খেলা দু’টি আলাদা। আর সেই দূরত্ব বজায় রাখাটাই সুবিবেচনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy