প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলশিক্ষাব্যবস্থায় পঠনপাঠন, পরিকাঠামো— সর্বত্রই যেন এক তীব্র অনটনের ছাপ। এক দিক পূরণ করতে গেলে অন্য দিকটি অচিরেই বেআব্রু হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় স্কুলশিক্ষাকে উন্নততর করার উদ্যোগ করতে হলে গুরুত্ব বিচার করে পরিকল্পিত পদক্ষেপ করা একান্ত প্রয়োজন। অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরে এমন সুপরিকল্পনার আশা যে বৃথা, তা ইতিপূর্বে প্রমাণিত। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সরকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে আগ্রহী। সেই ‘উন্নয়ন চিত্র’ এমনই যে, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ট্যাব দিতে সরকারের চলতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৫০০ কোটি টাকা। অথচ, পরিকাঠামো বিপর্যস্ত হওয়ায় বহু স্কুল মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সেখানে স্কুল ভবন সারানোর অর্থ নেই, বর্ষায় ভাঙা ছাদ দিয়ে জল পড়ে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ নেই। এমনকি যে মিড-ডে মিল ব্যবস্থা বহু দরিদ্র শিক্ষার্থীকে প্রত্যহ স্কুলের পথে টেনে আনে, তার জন্য উপযুক্ত রান্নাঘরটুকুও অমিল বহু ক্ষেত্রে।
নিঃসন্দেহে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হওয়া শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধর্ম। কিন্তু তার জন্য শুধুমাত্র ট্যাব বিতরণই যথেষ্ট নয়। ট্যাব, মোবাইল, ল্যাপটপের গুরুত্ব সর্বাধিক অনুভূত হয়েছিল অতিমারির সময়, যখন দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়গুলি বন্ধ থাকায় অনলাইন পঠনপাঠনই শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে। সেই আপৎকালীন পরিস্থিতি এখন আর নেই। শিক্ষাব্যবস্থাকে রাতারাতি ক্লাসরুমের বাইরে নিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ অনলাইন করে দেওয়ার কোনও আশু পরিকল্পনাও নেই রাজ্য সরকারের। তবে শুধুমাত্র এই খাতে এমন বিপুল ব্যয়ের প্রয়োজন কী? শিক্ষা দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, এই বছর থেকে একাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারাও ট্যাবের জন্য টাকা পাবেন। এত দিন সেই টাকা বরাদ্দ হত দ্বাদশ শ্রেণির জন্য। সুতরাং, চলতি বছরে একাদশ-দ্বাদশ উভয় শ্রেণির পড়ুয়াদের একত্রে টাকা দিতে হচ্ছে বলে খরচের পরিমাণ এমন বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হল, যেখানে অনটন চরমে, সেখানে কোনও একটি শ্রেণির জন্য এর অর্ধেক টাকা খরচের চিন্তাও বাহুল্য নয় কি? ডিজিটাল যুগে ট্যাবের মতো সামগ্রী শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু যেখানে সরকার সামান্য স্কুল সারানোর টাকা দিতে অপারগ, মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গররাজি, সেখানে এই অর্থব্যয়ের পিছনে উপযুক্ত যুক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তথ্য বলছে, যে পরিমাণ টাকা এই খাতে ব্যয় হচ্ছে, তা দিয়ে ৭৫ হাজার স্মার্ট ক্লাসরুম, ১৫ হাজার নতুন শ্রেণিকক্ষ, ৭৫ হাজার সিসি-ক্যামেরা বসানো যেত। এই সবই শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি। বেসরকারি শিক্ষায় পড়ুয়াদের হাতে ট্যাবের টাকা তুলে দেওয়া হয় না, কিন্তু বহু স্কুলেই বিকল্প ব্যবস্থাগুলি রয়েছে। তাতে তাদের শিক্ষার্থী-সংখ্যা বিন্দুমাত্র কমেনি। সর্বোপরি, এই পরিমাণ টাকার কিয়দংশও যদি মিড-ডে মিল খাতে ব্যয় করা যেত, তবে শিক্ষার্থীদের দৈনিক পুষ্টির বিষয়টি জোর পেত। দরিদ্র শিক্ষার্থীর কাছে উঁচু ক্লাসে ট্যাব পাওয়ার আশার চেয়ে বর্তমানে এক বেলা পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবারের আকর্ষণ অনেক বেশি। এই গোড়ার বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে রাজ্য সরকার যে শিক্ষক-ছাত্রের অভাবে ধুঁকতে থাকা শিক্ষাব্যবস্থায় চমকের উপরেই ভরসা রাখল, তা দুর্ভাগ্যজনক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy