Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Manipur Violence

রক্তের মূল্যে

সমস্যার শুরু মেইতেই জনগোষ্ঠীকে জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে। মেইতেই সে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী, প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ তার অন্তর্ভুক্ত।

Manipur Violence.

মণিপুরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৩ ০৬:৪৩
Share: Save:

ভারতের অনেক ছোট রাজ্যের তুলনায় মণিপুরের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বিবিধ কারণে বার বার জাতীয় স্তরে খবরের শিরোনামে চলে আসার একটি ঐতিহ্য আছে এই রাজ্যের। বিদ্রোহ ও বিক্ষোভের নানা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত ও ব্যক্তিত্ব তৈরি করে এই রাজ্যে বাকি দেশের নজরে নিয়ে এসেছে এক জাজ্বল্যমান বাস্তব: দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের সমাজগুলির প্রতি জাতীয় স্তরে এখনও কী গভীর অবজ্ঞা আর অবহেলা। সম্প্রতি মণিপুরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আবারও সেই একই বার্তা নিয়ে এল। ‘দেখামাত্র গুলির আদেশ’ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এ দেশে সহসা দেখা যায় না। কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়ে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মতো ঘটনাও অন্যত্র সচরাচর ঘটে না। বুঝতে অসুবিধা নেই, প্রথমত, মণিপুরে যে সংঘর্ষ চলছে তা সামান্য নয়, সহজে সমাধানযোগ্য নয়। এবং দ্বিতীয়ত, এই সমস্যা আকস্মিক ভাবে তৈরি হয়নি, অনেক গভীরে শিকড় না থাকলে এত প্রবল ও রক্তাক্ত সংঘর্ষ ঘটতে পারত না। রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে কেন্দ্রকেও এর দায়িত্ব নিতে হবে। ঠিক সময়ে পদক্ষেপ করলে ঘটনা এমন ভয়াবহতায় পৌঁছত না।

সমস্যার শুরু মেইতেই জনগোষ্ঠীকে জনজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে। মেইতেই সে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী, প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ তার অন্তর্ভুক্ত। এত দিন কুকি ও নাগারা জনজাতি হিসাবে গণ্য হলেও মেইতেই-রা ছিল তার বাইরে। সাধারণ দৃষ্টিতে তাতে কোনও অসঙ্গতি ছিল না, কেননা আর্থসামাজিক ভাবে তারাই অনেক এগিয়ে, বাকিরা পিছিয়ে। কিন্তু তবু, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জনজাতি পরিচয়ের হাজারো সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে মেইতেই-রা এ নিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে ক্ষুব্ধ। এত দিনে সেই ক্ষোভের ফল ফলল, জনজাতি মর্যাদা দেওয়া হল। স্বভাবতই বাকি জনগোষ্ঠীরা এতে প্রবল রুষ্ট। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের জন্য সংরক্ষিত জায়গাটিতে এ বার মেইতেই-রাও ভাগ বসাতে আসছে। জমি থেকে চাকরি, শিক্ষাসুযোগ থেকে পারিবারিক নিরাপত্তা, সব কিছুই সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং, মণিপুরি সমাজের এক বড় অংশ প্রবল বেঁকে বসেছে: কোনও মতেই মেইতেই-দের জনজাতি পরিচয়ের স্বীকৃতি সে রাজ্যে মানা হবে না, এই মর্মে। তার থেকেই অগ্নিকাণ্ড, হত্যালীলা। প্রায় শ’খানেক মানুষের প্রাণনাশ ও সহস্র মানুষকে বিপন্নতায় পর্যবসিত করে সে রাজ্যে নেমে এসেছে মাৎস্যন্যায়।

সমস্যাটি জটিল, এবং সমস্যার প্রতি প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গিও অক্ষমণীয় রকমের অতিসরল। জনজাতি মর্যাদা বস্তুটিকে সংরক্ষণ নীতির সঙ্গে যুক্ত ভাবে দেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই, এ কথা যদি মেনে নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে এই মর্যাদা কারা পাবেন আর কারা পাবেন না, তার সঙ্গে স্থানীয় ক্ষমতাবিন্যাসের একটা অঙ্গাঙ্গি যোগ থাকা জরুরি। অর্থাৎ, এই মর্যাদাভেদ কোনও শূন্য তলে দাঁড়িয়ে হতে পারে না, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত বিচার করে তবেই কোনও গোষ্ঠীকে এই স্বীকৃতি দান করা যেতে পারে। যদি মেইতেই-দের এই স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যক হয়, সে ক্ষেত্রে অন্যান্য গোষ্ঠীর মতৈক্য তৈরি করার প্রয়াসটিও জরুরি ছিল। মতৈক্য সহজ না হতে পারে, কিন্তু তাই বলে মতৈক্য নির্মাণের অভিমুখেই না এগোনো কোনও সমাধান হতে পারে না। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রশাসনিক প্রবণতার কারণেই এত বড় সংঘর্ষ পরিস্থিতি উদ্ভূত হল। উপরন্তু, কেন্দ্রীয় সরকার এখন যে ভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা করছে তার মধ্যেও দমনের প্রবণতাই স্পষ্ট। এর ফলে সঙ্কট আপাতত ও আপাত ভাবে কমানো গেলেও ভবিষ্যতে তা আবার মাথা চাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা মজুত রইল। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে, বিশেষত মণিপুরের সঙ্গে, বারংবার দিল্লি যে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়— সেটি বশ্যতার। কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক এমন হওয়ার কথা ছিল না।

অন্য বিষয়গুলি:

Manipur Violence Manipur Clash
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy