প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল ছবি।
ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যের সঙ্গে কর্নাটকের প্রধানতম ফারাক সম্ভবত আর্থিক সমৃদ্ধিতে। মাথাপিছু গড় আয়ের অঙ্কেই হোক, বেকারত্বের হারের স্বল্পতাতেই হোক, ওয়ার্কফোর্স পার্টিসিপেশন রেট-এর অনুপাতেই হোক অথবা দেশের মোট জাতীয় আয়ে রাজ্যের ভাগের হিসাবেই হোক, জাতীয় গড়ের তুলনায় বহু যোজন এগিয়ে রয়েছে কর্নাটক। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেই রাজ্যেও তীব্র দারিদ্রজীর্ণ অঞ্চল রয়েছে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দারিদ্রের নিরিখে বিহার, মধ্যপ্রদেশ বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের সঙ্গে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মতো মধ্যসারির রাজ্যের সঙ্গেও, কর্নাটকের তুলনা চলে না। অর্থাৎ, এটি এমন একটি রাজ্য, যেখানে সরকারি খয়রাতির গুরুত্ব অন্য অনেক রাজ্যের তুলনাতেই কম হওয়ার কথা। কথাটি বিজেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘রেউড়ি রাজনীতি’র বিরুদ্ধে যে সুর বেঁধে দিয়েছেন, তার অনুরণন ঘটতে পারত কর্নাটকের নির্বাচনে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে— রেউড়ি বা দাতব্য নয়, বিজেপির প্রচারের কেন্দ্রে থাকতে পারত আর্থিক বৃদ্ধির অনুকূল পরিকাঠামো নির্মাণের, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে, নরেন্দ্র মোদী বর্ণিত রেউড়ি রাজনীতির মূল ব্যাপারি কংগ্রেস এবং তার ঘোর বিরোধী বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারের মধ্যে প্রতিশ্রুতির নিরিখে ফারাক করা মুশকিল। বছরে বিনামূল্যে তিনটি এলপিজি সিলিন্ডার থেকে সস্তায় বাড়ি, খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি— সবই রয়েছে বিজেপির প্রতিশ্রুতির তালিকায়। কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতির তালিকা দীর্ঘতর— কিন্তু, রেউড়ির বিরুদ্ধে জেহাদ যে-হেতু বিজেপির গোষ্ঠীপতির, ফলে সেই দলের ইস্তাহারটির তাৎপর্যও স্বাভাবিক ভাবেই বেশি।
পাইয়ে-দেওয়ার রাজনীতির ভালমন্দ সংক্রান্ত আলোচনা অন্যত্র। বর্তমানে প্রশ্ন হল, কেন বিজেপিকেও— এই রাজনীতির বিরুদ্ধে যাবতীয় ঘোষিত আপত্তি এবং অবজ্ঞা সত্ত্বেও— ইস্তাহার জুড়ে পাইয়ে-দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিলাতে হয়? এই প্রশ্নের একটি উত্তর হতে পারে এই যে, কর্নাটকে হাওয়া খারাপ দেখে বিজেপি ঝুঁকি নেয়নি, গরিবের মন জয়ের ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রয়োগ করেছে। কেউ বলতে পারেন যে, কারণটি এতখানি তাৎক্ষণিক নয়— পাইয়ে-দেওয়ার রাজনীতিই এখন ভারতীয় রাজনীতির প্রিয় কৌশল। কোন রাজ্যে সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, সে রাজ্যের মানুষ রাজনীতির কাছে কী প্রত্যাশা করেন, এই বিবেচনা ব্যতিরেকেই খয়রাতির প্রতিশ্রুতির বন্যা বইতে থাকে। ফলে, প্রতিশ্রুতির নিরিখে মহারাষ্ট্র-কর্নাটকের সঙ্গে বিহার-ছত্তীসগঢ়ের ফারাক করা যায় না।
সুতরাং প্রশ্ন করা প্রয়োজন, কেন তথাকথিত খয়রাতির রাজনীতিই ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোত হয়ে উঠল? কোনও দলের নির্বাচনী সাফল্যের পথে কেন ভোটারদের পাইয়ে-দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভিন্ন উপায়ান্তর নেই? এই প্রশ্নের উত্তর এক দিক থেকে ঘোর নেতিবাচক, অন্য দিক থেকে ইতিবাচক। নেতিবাচক, কারণ এই বাস্তব বলে দেয় যে, স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে আসার পরেও জনসংখ্যার একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ রাষ্ট্রের উপর আর্থিক নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাঁদের জন্য সেই সুযোগ তৈরি করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে বলেই। বহু মানুষের দু’মাসে একটি এলপিজি সিলিন্ডার কেনার মতো আর্থিক সঙ্গতি তৈরি হয়নি বলেই বিনামূল্যে সিলিন্ডারের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। কিন্তু, অন্য দিক থেকে দেখলে, কেন বিজেপির মতো দলও ‘রেউড়ি’র প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়, সেই কারণটির মধ্যে নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের জোর। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের প্রাপ্য ভিক্ষার দান নয়, তা অধিকার। খাদ্য থেকে জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা থেকে কর্মসংস্থান, প্রতিটি বস্তুই নাগরিক রাষ্ট্রের কাছে দাবি করতে পারে। নির্বাচনী ইস্তাহারগুলিতে স্বীকারোক্তি রয়েছে যে, মানুষ সেই দাবি করছে। তাকে অগ্রাহ্য করার শক্তি কোনও দলেরই নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy