প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
একুশ বছর আগে গুজরাতের সংহারপর্বে নানা সওয়াল-জবাবের মধ্যে শোনা গিয়েছিল নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কথা। ইতিমধ্যে দেশের রাজনীতি অনেক পথ হেঁটে এসেছে, নরেন্দ্র মোদী গুজরাত থেকে দিল্লিতে ঠিকানা বদলেছেন। কিন্তু তাঁর পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের জমানায় তৃতীয় সূত্র নিরলস কাজ করে চলেছে। দেশ ও দুনিয়া জেনে গিয়েছে যে, দিল্লীশ্বরদের নিন্দা বা সমালোচনায় সক্রিয় হলেই তার নিশ্চিত প্রতিক্রিয়া রূপে রাষ্ট্রশক্তির কোপ নেমে আসবে। এবং, নিউটনের সূত্রকে পিছনে ফেলে, প্রতিক্রিয়ার মাত্রা হবে ক্রিয়ার তুলনায় অনেক গুণ বেশি। বিরোধী রাজনীতিক, সত্যান্বেষী সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠন, জনস্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধ সমাজকর্মী— বিভিন্ন ধরনের সমালোচক নানা ভাবে এই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। ব্রিটিশ সম্প্রচার সংস্থা বিবিসি ২০০২ সালের গুজরাতের ঘটনাবলিতে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকার সমালোচনায় মুখর একটি তথ্যচিত্র প্রচারের স্বল্পকাল পরেই এই সংস্থার দিল্লি ও মুম্বই কার্যালয়ে আয়কর বিভাগের যে দীর্ঘ তল্লাশি চলল, তা তৃতীয় সূত্রের সাম্প্রতিকতম লীলা নয় কি? শাসক শিবিরের লোকেরা অবশ্যই এ প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে বলবেন: আয়কর বিভাগ নিয়মমাফিক অনুসন্ধান চালিয়েছে, তথ্যচিত্রের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এই উক্তি শুনলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জাহানারা নিশ্চয়ই মন্তব্য করতেন: আবার বলি, চমৎকার!
‘আবার’ কেন? এই কারণে যে, আয়কর হানার ঘটনাটি বিবিসি কাহিনিতে তৃতীয় সূত্রের প্রথম নয়, দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বটি ঘটে গিয়েছে আগেই, যখন ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন নামক তথ্যচিত্র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার তথা শাসক দল কেবল তার নিন্দায় মুখর হয়নি, ভারতে এই তথ্যচিত্রের প্রচার বন্ধ করতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের আইন এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র সেই যুদ্ধে একযোগে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘যুদ্ধ’ শব্দটি প্রায় আক্ষরিক অর্থেই সত্য— শাসকরা এই তথ্যচিত্রকে ভারতের বিরুদ্ধে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার বলে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর, এই তথ্যচিত্রকে উপলক্ষ করে দুনিয়ার নানা মহল থেকে ধ্বনিত নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা তাঁদের মতে গণতান্ত্রিক ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। স্পষ্টতই, জাতীয় স্বার্থ নামক প্রকরণটিকে তাঁরা পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করছেন এবং করবেন, জর্জ সোরস-এর সমালোচনার জবাবে স্মৃতি ইরানি ও তাঁর সতীর্থদের বিষোদ্গারে এই পরিকল্পনার অভ্রান্ত পরিচয়।
এই পরিকল্পনার দু’টি মাত্রা। এক দিকে, শাসকদের সমালোচনা এবং তাঁদের নীতি ও আচরণের প্রতিবাদকে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ বলে প্রতিপন্ন করা। অন্য দিকে, বিরোধী বা প্রতিবাদীদের উপর নানা দিক থেকে আক্রমণের কৌশল প্রয়োগ করে ভয়ের রাজত্ব জারি রাখা, যাতে সমালোচকরা সেই প্রত্যাঘাতের ভয়ে নীরব বা স্তিমিত থাকেন। এই দ্বিমাত্রিক তৎপরতার সাহায্যে বর্তমান শাসকরা দেশের অভ্যন্তরীণ সমালোচনাকে অনেক দূর অবধি প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছেন, প্রথমত, বহু প্রতিবাদী স্বর ভয়ের তাড়নায় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে গণ্য করবার মানসিকতা ভারতে অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বাইরে এই অস্ত্র কার্যকর নয়। যে সব দেশের সরকার দিল্লির নায়কদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, সেখানেও নানা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে বশে আনা কঠিন। বিবিসি থেকে জর্জ সোরস, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে নোম চমস্কি— কঠোর, যুক্তিনিষ্ঠ এবং তথ্যঋদ্ধ সমালোচনার তির বারংবার ছুটে আসছে। এই সব সমালোচনা গণতান্ত্রিক ভারতের বিরুদ্ধে নয়, রাষ্ট্রশক্তির অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে। শাসকরাও তা জানেন। সেই কারণেই আন্তর্জাতিক প্রতিবাদীদের প্রতি তাঁদের এত উষ্মা, এত বিরক্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy