কফি হাউসে সম্প্রতি যাহা ঘটিয়া গেল, তাহা কি শুধুই উত্তপ্ত নির্বাচনী রাজনীতির ফল? ‘মোদীপাড়া’ নামক বিজেপি-ঘনিষ্ঠ মঞ্চের প্রচার-অভিযান চলিতেছিল, চলিতেই পারে। সমাজমাধ্যমে দেখা গিয়াছে, কফি হাউসের টেবিল-চেয়ারে বসিয়া আছেন গেরুয়া টি-শার্ট পরিহিত যুবকেরা। বসিতেই পারেন, কফি হাউসের সংস্কৃতির তাহাতে আপত্তি নাই। পরে ওই যুবকদেরই ‘তাণ্ডব’ চালাইবার অভিযোগ উঠিল, কফি হাউসের দেওয়ালে-সিঁড়িতে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ লেখা পোস্টারে ‘নো’ শব্দটি মুছিবার বা পোস্টারগুলি ছিঁড়িবার দৃশ্য দেখা গেল। দেখা গেল হিংস্র আস্ফালন। প্রতিবাদ হইয়াছে তৎক্ষণাৎ, উপস্থিত বামকর্মীরা পাল্টা স্লোগান দিয়াছেন, পর দিন কফি হাউসের সামনে কেবল ‘বিজেপি ও আরএসএসের বিরুদ্ধে বাংলা’ গোষ্ঠীর সদস্যরাই নহে, কফি হাউস-অনুরাগী বিশিষ্টজন ও সাধারণ মানুষও একত্র হইয়া প্রতিবাদ সভা করিয়াছেন, নূতন পোস্টার লাগানো হইয়াছে।
ভোট-আবহে একটি ঘটনা বুদ্বুদের ন্যায় ভাসিয়া উঠিল, দুই দিনেই জনস্মৃতি হইতে মিলাইয়াও গেল, ইহাতেই এই কাণ্ডের শেষ নহে। অকুস্থল কফি হাউস বলিয়াই ইহাকে বিক্ষিপ্ত ঘটনাও বলা যাইতেছে না। খানিক তলাইয়া দেখিলেই বৃহত্তর ছকটি ফুটিয়া উঠিবে। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ লেখা পোস্টার শহরের বিস্তর জায়গায় পড়িয়াছে, সেইগুলি ছাড়িয়া হঠাৎ কফি হাউসেই কেন তুলকালাম? উত্তর অজানা নহে। কফি হাউস যুগ যুগ ধরিয়া মুক্ত চিন্তা, প্রজ্ঞা ও মননের ধাত্রীভূমি। বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিরও তাহা প্রাণকেন্দ্র, এবং তাহা সুদীর্ঘ কয়েক দশক ধরিয়া। কফি হাউস সংলগ্ন বিদ্যায়তনগুলির এবং কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার সংস্রব সেই মুক্ত চিন্তার পরিসরকে পরিপুষ্ট ও সুদূরপ্রসারী করিয়াছে, কফির পেয়ালায় মত, দ্বিমত ও ভিন্ন মতের তুফান উঠিয়াছে। মতান্তর, তর্কবিতর্ক হইয়াছে বিস্তর, এবং কফি হাউসে তাহা বরাবরই স্বাগত, কারণ প্রতর্কময় সংলাপই সুস্থ গণতন্ত্রের অভিজ্ঞান। বহু মতের পরিপোষণ বিজেপির সহজাত নহে, বহু স্বরকে দাবাইয়া সংখ্যাগুরুবাদের এক ও একমাত্র স্বরকেই স্লোগানে ফাঁপাইয়া তুলিতে দেখা গিয়াছে এই দলের নেতা-মন্ত্রী হইতে সাধারণ কর্মী সকলকেই। অথচ, কলিকাতার ঐতিহ্যবাহী এই জায়গাটির উপরে নিজেদের প্রতাপ না ফলাইলেও চলে না, তাই টেবিল দখল করিবার, পোস্টার ছিঁড়িবার পথ অবলম্বন।
বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্রের উত্তরাধিকার যেমন এক অর্থে বাঙালিত্বের সংজ্ঞা নির্মাণ করে, কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসও আর এক অর্থে তাহা করিয়া থাকে। জনমানসে তাহার সেই প্রতিষ্ঠা আছে। এই কারণেই, কফি হাউসে গৈরিক বাহুবলীদের তাণ্ডবকে বিজেপির রাজনৈতিক প্রকল্পের একটি ধাপ হিসাবে দেখা বিধেয়। যে ভঙ্গিতে তাহারা বঙ্গমনীষীদের আত্মসাৎ করিতে তৎপর— তাঁহাদের নৈতিক অবস্থান, বহু-সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদিকে ছাঁটিয়া, শুধুমাত্র কিছু মূর্তি হিসাবে আত্মসাৎ করিতে চাহে বিজেপি— ঠিক সেই ভঙ্গিতেই, তর্ক-ভিন্নমতের পরিসরের পরিচিতিটিকে মুছিয়া ফেলিয়া কফিহাউসের বহিরঙ্গ দখল করিতে চাহে। লক্ষণীয়, এই বারের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার ও বাঙালির বিবিধ সংস্কৃতির প্রতীক দখল করিবার ধুম পড়িয়াছে। এই বারের নির্বাচনের ইহাই বিশেষত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy