সঙ্কটের আঁধার ঘনাইয়া আসিলে দৃষ্টি নিকটেই আবদ্ধ থাকিতে চাহে, প্রসারিত হইতে পারে না। অথচ আপৎকালীন প্রয়োজন মিটাইতে গিয়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ভুলিয়া থাকিলে সমস্যা আরও গভীর হয়। দেশের চরম আর্থিক সঙ্কটেও যে কেন্দ্রীয় সরকার চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতির প্রয়োজন বিস্মৃত হয় নাই, ইহা আশার কথা। পৃথক প্রকল্পের সূচনা করিয়া টাকা বরাদ্দ করিয়াছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ‘প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর স্বাস্থ্যভারত যোজনা’-র অধীনে ছয় বৎসরে চৌষট্টি হাজার কোটি টাকা ব্যয় হইবে। জেলাগুলিতে নূতন পরীক্ষাগার ও স্বাস্থ্য ইউনিট নির্মিত হইবে, গ্রাম ও শহরে আটাশ হাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্র সহায়তা পাইবে। গড়ে দশ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক ব্যয় যথেষ্ট কি না, সে বিতর্ক চলিতে পারে। কিন্তু ইহাও সত্য যে, বহু দশক ধরিয়া যে সমস্যা তৈরি হইয়াছে, তাহা এক দিনে মিটিবার নহে। ভারতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর দুর্বলতার মূলে রহিয়াছে কয়েক দশকের বরাদ্দ-বঞ্চনা। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং সরকারি চিকিৎসা কখনও ভারতে যথেষ্ট গুরুত্ব পায় নাই। মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) দেড় শতাংশের উপরে কখনও তাহার বরাদ্দ উঠে নাই। ফলে চিকিৎসা পরিকাঠামোয়, বিশেষত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবায়, বিস্তর ফাঁক রহিয়াছে। দেশের আয়ের নিরিখে ভারতের সমপর্যায়ে রহিয়াছে যে দেশগুলি, তাহাদের অধিকাংশ স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি-র তিন-চার শতাংশ খরচ করে, পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলি পাঁচ-সাত শতাংশ। ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০১৭) সুপারিশ করিয়াছিল, জিডিপি-র অন্তত আড়াই শতাংশ বরাদ্দ করিতে হইবে স্বাস্থ্য খাতে। এ বৎসর স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ১৩৭ শতাংশ বাড়িয়াছে, এমনই দাবি করিয়াছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
স্বাস্থ্য বাজেটের এই হিসাবে অস্বচ্ছতা রহিয়াছে, এমন অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠিয়াছে। যে বরাদ্দগুলি কখনও কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বাজেটে প্রতিফলিত হয় নাই (যথা, কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন হইতে রাজ্যগুলির প্রাপ্য অর্থ), তাহাও কেন ধরা হইয়াছে, প্রশ্ন করিয়াছেন অনেকে। সেই সমালোচনার উত্তর কেন্দ্রকেই দিতে হইবে। তবে দেড় লক্ষ ভারতীয়ের প্রাণ লইয়াছে করোনা অতিমারি, সেই হিসাবটিও ভুলিলে চলিবে না। ভারতের স্বাস্থ্য চিকিৎসাব্যবস্থার ক্ষতগুলি স্পষ্ট করিয়াছে কোভিড— তাহা গ্রাম ও ব্লক স্তরে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সুলভ চিকিৎসার অভাব। এ বার কেন্দ্র ঘোষণা করিল, রোগ নির্ণয়ের জন্য আরও পরীক্ষাগার স্থাপিত হইবে, ব্লক ও জেলা হাসপাতালে আপৎকালীন চিকিৎসার ব্যবস্থা হইবে। সংক্রমণ নিবারণের জন্য, অসংক্রামক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য এই পরিকাঠামোর প্রয়োজন আছে, সন্দেহ নাই। আগামী অর্থবর্ষে দশ হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় ব্যয় হইলে তাহা চিকিৎসার উন্নতির সহিত বহু কাজও সৃষ্টি করিবে। আজ যাহার প্রয়োজন সর্বাধিক।
তবে কিছু প্রশ্ন থাকিতেছে। অতিমারিতে দেশবাসীর ব্যয়ক্ষমতা কমিয়াছে, অপুষ্টি-রক্তাল্পতা বাড়িয়াছে। এই সময়ে চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার যথাসম্ভব বহন করিবে, জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের নিকট এমনই প্রত্যাশা ছিল। তাহা পূর্ণ হইল কি? স্বাস্থ্যরক্ষার প্রধান প্রকল্পগুলিতে অর্থ বরাদ্দ কার্যত কমিয়াছে। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের বরাদ্দ ২০১৯-২০ সালের বাস্তবিক ব্যয়ের প্রায় সমতুল। নগর স্বাস্থ্য মিশনে বরাদ্দ কমিয়াছে। চলতি আর্থিক বৎসরে স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক প্রয়োজনগুলি মিটাইতে যত খরচ হইবে, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সেইগুলির জন্য বরাদ্দ কমিয়াছে আট হাজার কোটি টাকা। সরকার চিকিৎসার ব্যয় বহন না করিলে তাহা বহিতে হয় নাগরিককে। দারিদ্রে পতিত হইবার অন্যতম কারণ চিকিৎসা। সেই বিপুল ব্যয়ভার হইতে মুক্তির সম্ভাবনা এ বারও দেখা গেল না, এই আক্ষেপ থাকিবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy