ফাইল চিত্র।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তান নামক দেশটির উপর যে কী দুর্নিয়তি নামিয়া আসিয়াছিল, কেমন ঘৃণ্য, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও পরোয়াহীন গ্রেফতারির মধ্যে পড়িয়াছিলেন রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা-কর্মীরা ও সাধারণ মানুষ, সেই ইতিহাস বহু-চর্চিত। সেই রাত্রেই বন্দি হইয়াছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তানের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি আবার দেশের মাটিতে পা রাখিতে পারিয়াছিলেন দেশ মুক্ত হইবার পর— ১৯৭২ সালে। ওই ২৬ মার্চেই বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূমির গোড়াপত্তন। ভারতের মাটিতেও দিনটির গুরুত্ব কম নহে। যদিও ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ লইয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রামে নামিয়াছে একাত্তর সালের ডিসেম্বরে, নয়াদিল্লির নথিপত্র অনুযায়ী ২৫ মার্চে মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে শেখ মুজিবের ‘এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ ঘোষণার পর পরই ভারত সরকার স্পষ্ট বুঝিতে পারে, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, এবং সে যুদ্ধ ভারতেরও। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী বাঙালিকে বাঁচাইতে ভারতের দায়িত্ব অনেকখানি, মুখ ফিরাইয়া বসিয়া থাকা যাইবে না। ২৬ ও ২৭ মার্চ মন্ত্রিসভার দুইটি জরুরি বৈঠক হয়, গৃহীত হয় কিছু প্রয়োজনীয় সামরিক সিদ্ধান্ত। অর্ধশতক আগে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস স্মরণ করিলে বোঝা যায়, পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং ভারত— সকলেই আসলে ১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক ভ্রান্তি সংশোধনের সংগ্রামটি লড়িতেছিল সে দিন: ১৯৭১ সাল প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ সালের আবশ্যিক পরবর্তী ধাপ।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গঠনের ঐতিহাসিক অবশ্যম্ভাবিতা নিশ্চয়ই এই উপমহাদেশকে কিছু শিক্ষা দিয়া গিয়াছে। প্রশ্ন হইল, উপমহাদেশ সেই শিক্ষা গ্রহণ করিবার উপযুক্ত বিবেচনা দেখাইতে পারিতেছে কি না। কেন পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান হইতে আলাদা হইতে হইয়াছিল ধর্মের সংযোগ সত্ত্বেও? কেননা জাতীয়তাবাদের ও জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মের উপর হইতে পারে না। জাতীয় ভাবের মধ্যে ধর্মচেতনা মিশিয়া থাকিতে পারে, কিন্তু প্রধান উপাদানে পরিণত হইবার মতো গুরুত্ব তাহাকে দিতে নাই। ধর্মের উপরে উঠিতে না পারিলে রাষ্ট্রেরই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এই দিক দিয়া, বাংলাদেশের জন্ম মহম্মদ আলি জিন্না ও মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ‘অ্যান্টি-থিসিস’। এই সত্যের বিপরীতে চলিতে চাহিয়াছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা, তাই খালিগায়ে খালিপায়ে সাধারণ মানুষের মরণপণ লড়াইয়ের কাছে তাঁহাদের শেষ পর্যন্ত পিছু হটিতে হয়। বিশ্বকূটনীতির নিয়মেই সেই অসহায় মানুষগুলির পাশে আসিয়া দাঁড়ায় অন্য সাহায্যকারী দেশ।
এই লড়াই যে শুরু হইয়াছিল বাংলা ভাষার অধিকারের দাবি হইতে, সেই তথ্যটিতেও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। ভাষা যে মানুষের কত আপনার জিনিস, আত্মীয়ের বাড়া আত্মীয়, সেই সত্তা তথা পরিচিতিকে যে অন্য কিছু দিয়া চাপা দিতে নাই, অন্য ভাষা দিয়া তো নহেই— ইহা একটি জরুরি শিক্ষা হইবার কথা ছিল। অন্য শিক্ষাটি সম্ভবত বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কিত। বিশ্বদুনিয়ার সব ভাষাভাষী মানুষের কি নিজের ভাষাটির উপর এতখানি মায়া ও আবেগ আছে? বলা মুশকিল। কিন্তু বাঙালির তাহা আছে। বাঙালি অনেক দূর যাইতে পারে, অনেক যুদ্ধ লড়িতে পারে তাহার ভাষা বাঁচাইতে, সংস্কৃতির প্রাণ বাঁচাইতে, বিশিষ্টতাকে রক্ষা করিতে। উর্দুভাষী শাসকরা ভাবিয়াছিলেন ভয় দেখাইয়া বাঙালিকে বশ করা যাইবে। যায় নাই। তাই পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বাংলাদেশের জন্ম দুই দেশজোড়া সমগ্র বাঙালির জন্যই একটি আত্মপ্রত্যয়ের বার্তা, বিজয়ের অভিজ্ঞান। এই মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গেও সেই বার্তা মহামূল্যবান। বিবিধ আগ্রাসনের চাপে উত্তরোত্তর স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে— আপন ভাষার মর্যাদাবোধ কতটা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy