প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
মাঝেমধ্যে এমন কিছু সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়, কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই যার বিরোধিতা করা দুষ্কর। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের একটি নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী তেমনই একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন— প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীনে আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হবে। গরিব মানুষের অন্নচিন্তা অন্তত আংশিক ভাবে লাঘব হবে, এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোই বিধেয়। তবে প্রশ্ন হল, এমন বিপুল তাৎপর্যপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নির্বাচনী জনসভাতেই ঘোষণা করতে হল কেন? স্বাভাবিক নিয়মে, অর্থাৎ সংসদে ও মন্ত্রিসভায় আলোচনার পর প্রশাসনিক ভাবে সিদ্ধান্তটি ঘোষিত হওয়াই কি উচিত ছিল না? এই প্রশ্ন অবশ্য অনর্থক— প্রধানমন্ত্রী যতই ‘রেউড়ি রাজনীতি’র বিরোধিতা করুন, ভোট এলে গরিবকে ‘উপহার’ দেওয়ার তাগিদটি এড়ানো রাজনীতিকমাত্রের পক্ষেই কঠিন। কারও কারও মনে পড়ছে, ২০১৩ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি তৎকালীন ইউপিএ সরকারের আনা খাদ্য নিরাপত্তা আইনটির বিরোধিতা করেছিলেন একাধিক যুক্তিতে— তার মধ্যে একটি যুক্তি ছিল, কারা এই আইনের অন্তর্ভুক্ত হবেন, তার মাপকাঠি অস্পষ্ট। তার পর এক দশক সময় কেটে গিয়েছে, যার নব্বই শতাংশেরও বেশি অংশ জুড়ে তিনিই দেশের ক্ষমতাশীর্ষে বিরাজমান। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রাপকদের মাপকাঠি তখন যতখানি ঝাপসা ছিল, এখনও ততটাই। বস্তুত, অন্ত্যোদয় যোজনা এবং প্রায়রিটি হাউসহোল্ড, এখনও রেশনের প্রাপক নির্ধারণে এই দুই শ্রেণির ব্যবহার অপরিবর্তিত। তা হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ মাপকাঠিগুলি অবিবেচনাপ্রসূত নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শুধু মাপকাঠিই নয়, প্রকল্পের ধারণার ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী শেষ অবধি পূর্বসূরি সরকারের সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। খাদ্যের নিরাপত্তা যে রাজনৈতিক আয়ুধ নয়, তা উন্নয়নের একটি জরুরি শর্ত, এই কথাটি প্রধানমন্ত্রী বুঝে থাকলে মঙ্গল। এমনকি, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে যদি তিনি আর দেশের প্রধানমন্ত্রী না থাকেন, তবুও। শাসক ও বিরোধী, উভয় তরফই যদি উন্নয়নের মৌলিক শর্ত সম্বন্ধে ঐকমত্যে উপনীত হতে পারেন, তবে তার চেয়ে সুসংবাদ হয় না।
প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী কি আদৌ বুঝেছেন যে, কেন (আরও পাঁচ বছরের জন্য) খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন? বিষয়টি যে আদৌ নির্বাচনী রাজনীতির নয়, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের— ক্ষুদ্র স্বার্থের সাধনাকে অতিক্রম করে সেই উপলব্ধিতে পৌঁছনো তাঁর পক্ষে আদৌ কি সম্ভব? প্রশ্নটি উঠছে, কারণ প্রাপকরা একই থাকলেও আগে যে খাদ্য নাগরিকের অধিকার ছিল, নরেন্দ্র মোদীর আমলে তা প্রধানমন্ত্রীর উপহার বা দয়ার দানে পর্যবসিত হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, কোনও নাগরিককেই যদি বিনামূল্যে খাদ্যপ্রাপ্তির অপেক্ষায় না থাকতে হয়, প্রত্যেকেই যদি বাজার ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই নিজের পরিবারের পুষ্টির ব্যবস্থা করতে পারেন, তার চেয়ে কাম্য পরিস্থিতি আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু বহুবিধ কারণে সেই অবস্থায় ভারত এখনও পৌঁছয়নি। প্রধানমন্ত্রী কখনও প্রকট ভাবে, কখনও প্রচ্ছন্ন সুরে বাজার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা পোষণ করার কথা বলেছেন, কিন্তু বাজার প্রক্রিয়াটি যাতে যথাযথ ভাবে চলতে পারে, সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। ফলে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল বণ্টনে ভারতীয় বাজার মোটের উপর ব্যর্থ— কতিপয় ধনী ক্রমে ধনীতর হয়েছেন, অন্য দিকে বিপুল জনগোষ্ঠীর আর্থিক সঙ্কটের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর আমলে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য— কিন্তু, তার পরেও ভারতে যে হারে বৃদ্ধি ঘটেছে, তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণ মানুষের কাছে সেই আর্থিক বৃদ্ধির সুফল পৌঁছে দেওয়ার প্রকৃষ্টতম পন্থা ছিল কর্মসংস্থান। ভারতে তা হয়নি। ফলে, মানুষের মুখে অন্ন জোগানোর দায়িত্বটি সরকারকে গ্রহণ করতেই হবে। নির্বাচনে জয়লাভের উদ্দেশ্যে নয়, নাগরিকের স্বার্থে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy