Advertisement
E-Paper

ধর্মের কাহিনি

ক্ষীণতম প্রশ্ন তুললেও যে শাসকরা প্রশ্নকর্তার প্রতি অসন্তুষ্ট বা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, এমন সমালোচনা নিশ্চয়ই তাঁদের প্রীত করবে না।

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩১
Share
Save

সনাতন ‘হিন্দু’ ধর্মের সর্বোচ্চ গুরু হিসাবে পরিচিত শঙ্করাচার্য চতুষ্টয় কেন অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রথমে তার বিশদ ব্যাখ্যা শোনা গিয়েছিল তাঁদের অন্যতম, উত্তরাখণ্ডে স্থিত জ্যোতির্মঠ-এর স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতীর মুখে। ব্যাখ্যার সার কথাটি হল: যাব না, কারণ যেতে পারি না। যেতে পারেন না, কারণ অযোধ্যার মন্দিরটি অসম্পূর্ণ। ধর্মীয় বিধি মানলে মন্দির সম্পূর্ণ না করে বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা যায় না। অর্থাৎ, অযোধ্যায় যে অনুষ্ঠান হতে চলেছে, তা ধর্মসিদ্ধ নয়। এমন অসিদ্ধ আয়োজন শঙ্করাচার্যেরা অনুমোদন করতে পারেন না। সুতরাং, তাঁরা ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন না। ধর্মীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে এই যুক্তিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু, কে না জানে, পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ ধর্মীয় অবস্থান। অতএব জ্যোতির্মঠের শঙ্করাচার্যকে খোলসা করে জানাতে হয়েছে, এই সিদ্ধান্তের জন্য লোকে তাঁদের মোদী-বিরোধী বলতে পারে, কিন্তু তাঁরা মোদী-বিরোধী নন, সনাতন ধর্মাচারের প্রতি নিজেদের নিষ্ঠাকে অক্ষুণ্ণ রাখার কারণেই ২২ জানুয়ারি অযোধ্যা থেকে দূরে থাকবেন।

ক্ষীণতম প্রশ্ন তুললেও যে শাসকরা প্রশ্নকর্তার প্রতি অসন্তুষ্ট বা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, এমন সমালোচনা নিশ্চয়ই তাঁদের প্রীত করবে না। এতদ্দ্বারা যে ধর্মগুরুরা তাঁদের সমারোহের বৃন্দগানে কিঞ্চিৎ বেসুর বাজিয়ে দিয়েছেন, সেই কণ্টকময় সত্যটিও তাঁদের পক্ষে সুখের নয়। শঙ্করাচার্যদের ‘আর্বান নকশাল’ বা ‘দেশদ্রোহী’ গোছের তকমা দেওয়া চলে না, কিন্তু তাঁদের উপর চাপ সৃষ্টির অন্য উপায় যে থাকতে পারে না এমন গ্যারান্টিই বা কে দিতে পারে? লক্ষণীয়, চার জনের কেউই— অন্তত এখনও পর্যন্ত— অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না বটে, কিন্তু সেই বিষয়ে ‘যৌথ বিবৃতি’তে সম্ভবত তাঁরা সকলে সম্মত তথা স্বচ্ছন্দ নন; একাধিক শঙ্করাচার্য নিজেদের অবস্থান স্বতন্ত্র ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। এই ঘটনাপরম্পরার পিছনে রাষ্ট্র তথা শাসক শিবিরের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রভাব কতখানি কার্যকর, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আবার, শঙ্করাচার্যেরা যে শুধু তাঁদের ঘোষিত কারণেই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকছেন, এমন কথাও নিশ্চিত ভাবে ধরে নেওয়া শক্ত। হয়তো তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন যে এই অনুষ্ঠানে তাঁরা যথেষ্ট গুরুত্ব পাবেন না, এক দিকে অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সংগঠন এবং অন্য দিকে সবার উপরে যিনি সত্য সেই মহানায়ক পাদপ্রদীপের পনেরো আনা আলো দখল করে নেবেন।

কিন্তু যদি সেই হিসাবই তাঁদের সিদ্ধান্তের প্রকৃত কারণ হয়, তা হলেও এই সিদ্ধান্ত ও তার সপক্ষে ঘোষিত যুক্তি এক গভীরতর বাস্তবকে নির্ভুল ভাবে চিনিয়ে দেয়। তা হল রাজনীতির বাস্তব। নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থ-বাহিনী যে হিন্দুত্বের ধ্বজা ধরে চলেছেন সেটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক, সেই রাজনীতির স্বার্থে সনাতন ধর্মের বিধি ও অনুশাসনকে পরিত্যাগ করতে তাঁদের তিলমাত্র দ্বিধা নেই। শঙ্করাচার্যেরা প্রশ্ন তুলেছেন, রামমন্দির উদ্বোধনের জন্য এত তাড়ার কী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর ধর্মগ্রন্থে মিলবে না, এর সহজ উত্তর আছে নির্বাচনী ক্যালেন্ডারে। সেই নির্ঘণ্টের মাপকাঠিতে বিচার করলে উদ্বোধনের নির্ঘণ্টে কোনও হঠকারিতা নেই, বরং তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। মোদ্দা কথাটি এই যে, লোকসভা ভোটের দিন সমাগত, অতএব রামমন্দির খুলে দেওয়া দরকার। রামলালার গৃহ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে কি না সে-প্রশ্ন নিতান্ত গৌণ, শাসকের ভোটের প্রয়োজনে তাঁকে অর্ধসমাপ্ত বাড়িতেই ঠাঁই নিতে হবে। সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক হিন্দুত্ব যে হিন্দু সমাজের নীতিকাঠামো বা সনাতন ধর্মের সমার্থক নয়, সে-কথা বহু দিন ধরেই বহুচর্চিত। অসমাপ্ত রামমন্দিরের এই উদ্বোধন অনুষ্ঠান সেই সত্যকে একেবারে নিরাবরণ করে দিয়েছে। দেশের নানা স্থান থেকে সংগৃহীত সাধুসন্ন্যাসী, গুরুদেব, বাবাজি, মাতাজি, চকমেলানো মন্দির, ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁয়া— ষোড়শোপচারে নির্বাচনী যুদ্ধের প্রস্তুতিই শাসকদের একমাত্র লক্ষ্য। অযোধ্যা এখন সেই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের নতুন ঠিকানা। সেই ঠিকানায় সনাতন ধর্মের ক’আনা অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে সপারিষদ নরেন্দ্র মোদীর মাথাব্যথার কারণ নেই। তিনি এগারো দিনের ‘ব্রত’ পালন করে ‘সমস্ত ভারতবাসী’র প্রতিনিধি হয়ে উঠতে ব্যস্ত। আর, তাঁর মহিমায় বিমুগ্ধ যে ভক্তমণ্ডলী এই ভোটযজ্ঞ দেখে ধর্মভাবে আপ্লুত, তাঁদের বুদ্ধি-বিবেচনা এবং কাণ্ডজ্ঞানের বহর দেখে বজরংবলীও নিশ্চয় মনে মনে বলছেন: রাম রাম!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ram Mandir Ram Temple Ayodhya

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}