গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা যতখানি বাড়বে, জোগানের পরিমাণ হবে তার চেয়ে কম। প্রতীকী ছবি।
আরও একটি গ্রীষ্মের সূচনালগ্নে ভারত ক্রমে পরিচিত হয়ে যাওয়া সঙ্কটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। জানা গিয়েছে, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা যতখানি বাড়বে, জোগানের পরিমাণ হবে তার চেয়ে কম। তার কারণ, কয়লার জোগানে ঘাটতি। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, ‘পিক সামার’, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুনের প্রখর গ্রীষ্মে কয়লার জোগান প্রয়োজনের তুলনায় দুই কোটি টন কম হবে। কেন্দ্রীয় শক্তি মন্ত্রকের পরিসংখ্যান বলছে, এই এপ্রিলে বিদ্যুতের মোট চাহিদা হবে ২২৯ গিগাওয়াট। গত বছর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ২১৬ গিগাওয়াটের সামান্য কম। এপ্রিলের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে মোট কয়লা প্রয়োজন হবে ২২.২ কোটি টন। ভারতে অভ্যন্তরীণ কয়লা জোগানের ৮৫ শতাংশ রয়েছে কোল ইন্ডিয়ার হাতে। কয়লা মন্ত্রকের পূর্বাভাস ছিল, এ বছর কোল ইন্ডিয়া ২০.৫ কোটি টন কয়লা জোগান দিতে পারবে। দেখা যাচ্ছে, জোগানের পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ কোটি টনের কাছাকাছি। সঙ্কটের চেহারাটি এখনও ২০২১ সালের গ্রীষ্মের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখনও অবধি যা পরিস্থিতি, তাতে কয়লা আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি সামাল দেওয়া সম্ভব। ২০২১-এর গ্রীষ্মে বেশ কিছু উৎপাদন কেন্দ্রে মাত্র তিন-চার দিন উৎপাদন চালানোর মতো কয়লা মজুত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে যথেষ্ট কয়লা মজুত করতে নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ, গত বারের বিপদ থেকে খানিক হলেও শিক্ষা নিয়েছে সরকার। ভারতে তা সুসংবাদ বইকি।
কিন্তু, প্রশ্ন অন্যত্র। গত বারের বিপদের পর বিকল্প শক্তির প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার যে কথা উঠেছিল, বিপদ কেটে যাওয়ার পর সেই কথাও হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। ভারতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েছে— তার সুফলও মিলেছে। কিন্তু, অন্যান্য বিকল্প শক্তির প্রতি যতখানি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন, কেন্দ্রীয় সরকার তা করেনি। আন্তর্জাতিক পরিবেশ কূটনীতির মঞ্চে ভারতের অবস্থানটি যথাযথ ভাবেই বহুমাত্রিক— এক দিকে কয়লা ব্যবহার করে দ্রুত উন্নয়নের পথে হাঁটার অধিকারটি বজায় রাখা, অন্য দিকে ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্ব স্বীকার করে ক্রমে নেট জ়িরো নিঃসরণের পথে হাঁটা। কিন্তু, ২০২১ সালের সঙ্কট দেখিয়েছিল যে, অতিরিক্ত কয়লা-নির্ভরতা বর্তমান আর্থিক বৃদ্ধির পথেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অতিমারির পর অর্থব্যবস্থা যখন সদ্য ঘুরে দাঁড়াতে আরম্ভ করেছিল, তখনই কয়লার ঘাটতিজনিত সঙ্কটে বিদ্যুতের জোগান ব্যাহত হওয়ায় শিল্পক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। অতএব, ভারতকে মানতে হবে যে, বিকল্প শক্তির পথে আরও জোর কদমে হাঁটা ভিন্ন উপায় নেই। যাত্রার অভিমুখ ভবিষ্যতের দিকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
তবে, ভারতের বর্তমান সমস্যাটির পিছনে অতীতের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। কয়লার জোগানের ঘাটতির পিছনে একটি বড় কারণ রেল পরিবহণের অপ্রতুলতা। এই মুহূর্তে প্রতি দিন ৪২৮টি মালগাড়ি প্রয়োজন কয়লা পরিবহণের জন্য, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৪১৮টি। কয়লাখনিগুলি দেশের পূর্বপ্রান্তে— পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে; বিদ্যুতের চাহিদা বেশি শিল্পোন্নত পশ্চিম ও উত্তর ভারতে। এই ভারসাম্যহীনতার বীজটি নিহিত রয়েছে ১৯৫২ সালের মাসুল সমীকরণ নীতিতে। কয়লা, লোহার মতো অত্যাবশ্যক খনিজ পণ্য পরিবহণের মাসুল সরকারি ভর্তুকিপ্রদানের মাধ্যমে গোটা দেশে সমান করার নীতি পূর্ব ভারতকে শিল্পবঞ্চিত করেছিল। এই সিদ্ধান্তের তৎকালীন রাজনৈতিক লাভ কী ছিল, সে-হিসাব কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। কিন্তু কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতাটি রয়ে গিয়েছে। কেন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র স্বার্থের চেয়ে দূরদর্শিতাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়, এই পরিস্থিতি তার মোক্ষম প্রমাণ। কিন্তু, রাজনীতি কি সেই শিক্ষা গ্রহণ করবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy