দেশ স্বাধীন, কিন্তু মুক্তি অধরা। সেই মুক্তি ক্রমশ সুদূরপরাহত হইতেছে, জানাইল দেশে দেশে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পর্যালোচনা করা আমেরিকান অলাভজনক সংস্থা ‘ফ্রিডম হাউস’-এর এই বৎসরের রিপোর্ট। ২০১৪ সাল হইতেই দেশে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের ক্রমাবনতি হইতেছিল, দ্বিতীয় বার নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হইবার পর হইতে অবস্থা আরও খারাপ হইয়াছে, এমনটাই বলিতেছে গবেষণা। রিপোর্টে গণতন্ত্রের বিচারে ভারত এখন ‘মুক্ত’ নহে, ‘অংশত মুক্ত’ দেশ। সেই কারণগুলিও স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে— শিক্ষাক্ষেত্র ও সংবাদমাধ্যমের উপর ক্রমবর্ধমান হুমকি, মানবাধিকার সংস্থাগুলিকে অন্যায্য চাপ, সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ইত্যাদি। আলাদা করিয়া বলা হইয়াছে করোনাজনিত লকডাউনের অকস্মাৎ ঘোষণায় পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কথা, হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলিয়া মুসলমানদের আক্রমণ, বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে ধর্মান্তরণ আইন চালু করিবার মতো বিষয়কে। বলা হইয়াছে, চিনের আধিপত্যবাদের বিপরীতে যেখানে গণতন্ত্রের পতাকা উড়াইবার প্রয়োজন ছিল, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল সেখানে ভারতকে একই আধিপত্যবাদের বিয়োগান্তক পরিণতির পথে চালিত করিতেছেন।
রিপোর্ট নূতন হইতে পারে, কিন্তু এই কথাগুলি— অভিযোগগুলিও— পুরাতন। সাম্প্রতিক অতীতে বিরোধী দলের নেতানেত্রী হইতে বিখ্যাত শিক্ষাব্রতী বা দেশের শুভবোধসম্পন্ন বহু নাগরিকের মুখে বহু বার শোনা গিয়াছে। বিশেষত স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, এবং সেই মত বিরুদ্ধ স্বরের হইলেও তাহা বলিবার স্বাধীনতা যে এই কেন্দ্রীয় সরকার মুহুর্মুহু হরণ করিতেছে, সেই কথাটি উঠিয়া আসিয়াছে বারংবার। আরও উদ্বেগের, এই প্রক্রিয়াটি হইতেছে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ সক্রিয়তায়। সম্প্রতি রবিশঙ্কর প্রসাদ, প্রকাশ জাভড়েকর, স্মৃতি ইরানি, এস জয়শঙ্কর-সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের একটি গোষ্ঠী সুপারিশ করিয়াছে, দেশে যাঁহারা সরকারের সমালোচনা করিতেছেন, তাঁহাদের থামানো দরকার। তাই তাঁহাদের পরামর্শ, আন্তর্জাল বা সমাজমাধ্যম-ব্যবহারকারী নাগরিকই হউন কিংবা সাংবাদিকই হউন, কেন্দ্রীয় সরকার-বিরোধী লোকজনের উপরে নজরদারি করা হউক! কেহ এক ধাপ আগাইয়া পঞ্চাশ জন ‘নেতিবাচক প্রভাবশালী’কে চিহ্নিত করিবার কথাও বলিয়াছেন, সরকারের পক্ষে যাঁহারা সমালোচনার যোগ্য জবাব দিতেছেন, তাঁহাদের হাতে সুযোগসুবিধা-রূপ পুরস্কার ধরাইবার প্রস্তাবও উঠিয়া আসিয়াছে!
সুস্থ গণতন্ত্র বহু মত ও পথের পথিকের নিরন্তর সংলাপ, কোনও স্বর অপ্রিয় হইলেও তাহার কণ্ঠরোধ করিতে নাই, বরং তাহা কান খুলিয়া শোনা বিধেয়— অগণিত বার স্মরণ করাইয়াও লাভ হইতেছে না। বরং দেখা যাইতেছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই ক্ষমতার বলে জনস্বরকে দমাইবার কাজে উঠিয়াপড়িয়া লাগিয়াছেন, সেই স্বর শাসকতোষ নহে বলিয়া। এত দিন বিরুদ্ধস্বরকে দমাইতে পরোক্ষ পন্থার— হুমকি, হেনস্থা, চরিত্রহননের— প্রকোপ বেশি ছিল, গণতান্ত্রিক চক্ষুলজ্জাটুকু তবু বিদ্যমান ছিল। কুমন্ত্রণার জেরে এই বার প্রতিবাদী স্বর দমাইবার পথটি অলজ্জ, প্রত্যক্ষ হইল। অধঃপাতের পথটিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy