Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Nabanna

কার প্রতিষ্ঠা

হতে পারে এই সবই অতি-আশঙ্কা, অনাবশ্যক উদ্বেগ। হয়তো এ এক উদাসীন ভুল— সাতপাঁচ না ভেবে হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অভিনিবেশ এড়িয়ে প্রকাশিত হয়েছে সরকারি শুভেচ্ছাবার্তায়।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০৯
Share: Save:

শব্দ নিছক অক্ষরসমষ্টি নয়। তার অন্তঃস্থ ভাব, ব্যঞ্জনা, ইঙ্গিত ও অর্থে লুকিয়ে তার গুরুত্ব; আবার কে সেই শব্দ প্রয়োগ করছে, সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা-ও। যদি তার ব্যবহার হয় শাসক বা সরকারের হাতে, নাগরিককে বার্তা দিতে, তবে তো কথাই নেই। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ: এ বছর বাংলা নববর্ষের দিন পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে, বিজ্ঞাপনে বড় বড় করে লেখা ‘বাংলার প্রতিষ্ঠা দিবস’ শব্দগুলি। ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ বা ‘বাংলা দিবস’ নিয়ে এ রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক চাপানউতোর চলেছে গত বছর থেকেই, বিজেপির উদ্‌যাপিত ২০ জুনের পাল্টা তৃণমূল কংগ্রেস বেছে নেয় বাংলা নববর্ষের দিনটি। কিন্তু ঠিক যে কারণে বাংলা নববর্ষের দিনটি তৃণমূল যে কারণে বেছে নিয়েছে তার সঙ্গে অন্তত বাংলার ‘প্রতিষ্ঠা’ বা গোড়াপত্তনের কোনও যোগ নেই, তাই শুভেচ্ছাবার্তায় ওই শব্দের প্রয়োগও ভুল। ‘রাজ্যের সকল নাগরিককে পশ্চিমবঙ্গ দিবসের শুভেচ্ছা’-ই কি যথেষ্ট নয়?

শুধু ঠিক-ভুলের প্রশ্ন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে আবেগের প্রশ্নটিও। ১৯৪৭-এর ২০ জুন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় বাংলা ভাগের বিষয়টি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল: মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি, অবধারিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল অখণ্ড বাংলার বিভাজন। ২১ জুন ১৯৪৭ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, “বাঙলার যে অংশ ভারতবর্ষ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পাকিস্থানে পরিণত হইতে চলিয়াছে, তাহার জন্য গভীর বেদনা অনুভব করিতেছি... অচিরকাল মধ্যে বিচ্ছিন্ন পূর্ব বাঙলা আপনার স্বার্থেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিবে।” তা আর হয়নি, দেশভাগ ও বাংলা ভাগ আজও ভারতের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাসে রক্তাক্ত কাঁটা হয়ে জেগে আছে। ২০ জুন সেই ব্যথাতুর ঘোষণার দিন, বিজেপি এ দিনটি বাংলা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে তাদের চিরাচরিত ধর্মীয় মেরুকরণের বিষয়টি জিইয়ে রাখতেই, বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার বিপরীতে, ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দ্যোতক হিসাবেই নববর্ষের দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে বেছে নেয় তৃণমূল সরকার, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিকে রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে বাছাইও তারই চিহ্ন। ধর্ম নয়, সংস্কৃতি; বিভেদ নয়, আবহমান সম্প্রীতি— এ-ই বার্তাই তো শুভবোধসম্পন্ন যে কোনও বাঙালিকে আকর্ষণ করবে। সেখানে প্রতিষ্ঠা দিবস বা জন্মদিন গোছের শব্দে বিভ্রান্তি জাগতে বাধ্য, রাজ্য সরকারও কি বিজেপির মতোই পশ্চিমবঙ্গকে ‘প্রতিষ্ঠা’ দেওয়ার টক্করে তৎপর হয়ে উঠল?

হতে পারে এই সবই অতি-আশঙ্কা, অনাবশ্যক উদ্বেগ। হয়তো এ এক উদাসীন ভুল— সাতপাঁচ না ভেবে হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অভিনিবেশ এড়িয়ে প্রকাশিত হয়েছে সরকারি শুভেচ্ছাবার্তায়। আবার এই জন্যই তা ভয়ঙ্কর, কারণ তা জাগিয়ে তোলে এই প্রশ্নটি: এই মুহূর্তে কি তৃণমূল দল বা সরকারে এমন কেউ-ই নেই যিনি এই প্রবল অসঙ্গতিটি তুলে ধরতে পারেন যথাস্থানে, বুঝিয়ে দিতে পারেন কেন জনপরিসরে আপাত-সাধারণ দু’-একটি শব্দের অসতর্ক ব্যবহারই হয়ে উঠতে পারে অস্বস্তিকর, স্ব-দর্শনঘাতী? ভুল মাত্রেই সংশোধনযোগ্য, কিন্তু ভুল ধরিয়ে দেওয়ার স‘চেতন’ মানুষের অভাব আরও ভয়ঙ্কর।

অন্য বিষয়গুলি:

Nabanna TMC West Bengal BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy