যুবরাজ উইলিয়াম এবং তাঁর ভাই রাজকুমার হ্যারি। ছবি: সংগৃহীত।
সময় যে কত দ্রুত পাল্টে চলে, চলমান সময়ে ডুবে থেকে অনেক ক্ষেত্রেই তা পুরো বোঝা যায় না। একটু দূরে দাঁড়ালে তবেই যেন পরিবর্তনের নকশা ধরা পড়ে। সেই রকম ‘দূর-দৃষ্টি’ দেখিয়ে দেয় যে, ইউক্রেনের বাইরেও একটি ভীষণ লড়াই চলছে এই মুহূর্তে— সে যুদ্ধ দুই প্রতাপশালী রাজকুমারের মধ্যে। ইংল্যান্ডের রাজ-সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ উইলিয়াম এবং তাঁর ভাই রাজকুমার হ্যারি পরস্পরের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছেন। উইলিয়ামের প্রতাপ সুবোধ্য, তাঁর দিক থেকে সম্প্রতি ভেসে এসেছে ভাইয়ের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হুমকিও। পার্লামেন্টে টোরি এমপি-রাও ধুয়ো তুলেছেন, ছোট রাজকুমার ও তাঁর পত্নীর রাজ-পরিচয় ও মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হোক। তবে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য মহাদেশে বসবাসকারী হওয়া সত্ত্বেও হ্যারির প্রতাপ কিছু কম নয়, তাঁর রাজপরিবার-বিরোধী প্রচার এখন দেশবিদেশের হেডলাইন। হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগান তাঁদের মানসিক নির্যাতনের কাহিনি সর্বসমক্ষে এনে গোটা বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছেন। সংঘর্ষের এই তিক্ত রূপ দু’শো বছর আগে হলে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পর্যবসিত হত, রক্তে ভেসে যেত বহু প্রান্তর। একশো বছর আগে হলে হয়তো সঙ্কটাপন্ন হত সাম্রাজ্যও। কিন্তু এখন এই যুদ্ধ আবদ্ধ থাকে ব্রিটিশ ওষ্ঠাধরের দৃঢ়বক্র ভঙ্গিমায়, আর বিশ্বময় অর্বাচীন প্রচারমাধ্যমের পৃষ্ঠায়, পর্দায়, অবিরাম চর্চায়। আগে হলে এই যুদ্ধের খবর আসত রণক্ষেত্র থেকে সতর্ক নিয়ন্ত্রণে। এখন খবর দৌড়য় হাওয়ার আগে, ত্বরিতচকিত নেট-তরঙ্গে, তাবৎ দুনিয়ার বৈঠকখানায়, শয়নগৃহে, মুঠোফোনে।
বাস্তবিক, এই যুদ্ধ নিছক কয়েক জন ব্যক্তির সংঘর্ষ নয়। কোনও ব্যক্তিগত কাহিনি বলেও একে তাচ্ছিল্য করা যায় না। এ এক প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কটের অখ্যান, এক বিরাট ঐতিহাসিক তাৎপর্য লুকিয়ে আছে এই আখ্যানের মধ্যে। গোড়াতেই ঘটেছিল বিপদ, যখন ব্রিটেনের গণতন্ত্র তার রাজ-ঐতিহ্যকে পাশে নিয়ে চলতে চেয়ে একটি সোনার পাথরবাটি-তন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে যা মানায়, বিংশ-একবিংশে যে তার হয় বর্জন, কিংবা নবরূপায়ণ জরুরি হতে পারে, তা নিয়ে ব্রিটিশ সমাজ ও রাজনীতি ভাবতে চায়নি। এক দিকে চলেছে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মুক্ত নাগরিকতার বোধে জাতীয় আত্মসিঞ্চন। অন্য দিকে রাজ-প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রীয় নিবেদনের সংস্কৃতিটিকেও অব্যাহত রাখা হয়েছে সযত্নে। লক্ষণীয়, অন্য যে সব দেশে এখনও রাজতন্ত্র আছে, ব্রিটিশ রাজপরিবারকে যেন তাদের তুলনাতেও অনেক বেশি ঐতিহ্যমনস্ক ও ক্লাসিক্যাল থাকার চাপ নিতে হয়, এমনই বিপুল সেখানে জনপ্রত্যাশা ও সেই প্রত্যাশার উচ্চরব প্রকাশ। রাজপরিবারের সদস্যদের এমন জীবনযাপন করতে হয়, যা তাঁদের ‘ব্যক্তিগত’ নয়, বরং ‘দেশ’-এর জন্য নিবেদিত। এই প্রবল চাপের বলি হয়েছেন অনেকেই। সদ্যপ্রয়াত রানির পিতৃব্য অষ্টম এডওয়ার্ডকে রাজসিংহাসন ছেড়ে দিতে হয়েছিল বিবাহঘটিত জটিলতায়। রানির সহোদরা মার্গারেটও নিজের ডিভোর্সি প্রণয়ীকে বিবাহ করার অনুমতি না পেয়ে অসুখী জীবন যাপন করেছেন। রানির জ্যেষ্ঠপুত্র, বর্তমান রাজা, তৃতীয় চার্লসের ক্ষেত্রেও আধুনিক অধিকার-মনস্কতা ও রাজপ্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যরক্ষার সাঁড়াশি চাপ অসহ হয়ে উঠেছিল। লেডি ডায়ানার সঙ্গে চার্লসের অসুখী বিবাহ ও শেষে বিবাহবিচ্ছেদ, প্রচার-মাধ্যমের উন্মাদনায় ডায়ানার অনিঃশেষ যন্ত্রণাভোগ ও অকালমৃত্যু, চার্লস-ক্যামিলার প্রণয়সম্পর্কে অন্তহীন বাধা ও তাঁদের বিবাহে সামাজিক প্রতিক্রিয়া: সব মিলিয়ে যে দুঃসহ উত্তরাধিকার, তা-ই যেন এ বার রাজকুমার হ্যারির জীবনে নতুন জটিলতায় উন্মোচিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, হ্যারি ও মেগানের একটি বিশেষ অভিযোগ রাজপরিবারের প্রচ্ছন্ন ‘বর্ণবিদ্বেষী’ মনোভাবের বিরুদ্ধে: মেগানের মিশ্র-বর্ণ ঐতিহ্য নাকি হাজার বছরব্যাপী ব্রিটেন শাসনকারী উইন্ডসর রাজপরিবার মোটেই সুদৃষ্টিতে দেখেননি। অভিযোগ ও প্রত্যভিযোগ যত সঙ্কীর্ণই শোনাক, বিষয়টি আসলে যুগপৎ বৃহৎ ও গভীর। ব্রিটেনের রাজপরিবারের এই দুর্যোগ আসলে সময়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান তাল মিলিয়ে চলতে না পারার সঙ্কট। দুই আপাত-বিরোধী তন্ত্রকে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর অসম্ভব এক বাসনার সঙ্কট। মুক্ত সমাজের অভিমুখে হেঁটেও জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবিদ্বেষের সংস্কারকে ত্যাগ না করতে চাওয়ার সঙ্কট। তারই ফল আজকের এই রাজকুমার-দ্বৈরথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy