জামিনই নিয়ম, জেল ব্যতিক্রম— এই বিধি ভারতে এতই নির্বিচারে লঙ্ঘিত হয় যে, জামিন দানের রূপরেখা দিয়ে পৃথক আইন তৈরির পরামর্শ দিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিল যে, জামিনের আবেদন পেশ করার দু’সপ্তাহের মধ্যে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আদালতকে। এ সংবাদ স্বস্তির। পুলিশের অকারণে গ্রেফতার করার ঝোঁক, এবং আদালতগুলির জামিন খারিজের প্রবণতা লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিপন্ন করছে। দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতে জেলবন্দিদের দুই-তৃতীয়াংশ বিচারাধীন বন্দি— অর্থাৎ, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই তাঁরা কার্যত শাস্তি ভোগ করছেন। এই দুর্ভাগা মানুষদের মধ্যে দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত মানুষই বেশি, এবং অনেকেই মহিলা। তাঁদের জামিনহীন বন্দিদশা সুবিচারের স্বার্থে নয়, সমাজের নিরাপত্তার স্বার্থেও নয়— তাঁরা জেলে রয়েছেন, কারণ জামিন মঞ্জুর করানোর মতো আইনি সহায়তা তাঁদের জোটে না। দীর্ঘ কারাবাসের পর নির্দোষ প্রমাণিত বন্দির সংখ্যা কম নয়। সংখ্যায় আরও বেশি সেই ব্যক্তিরা, যাঁরা যে অপরাধে অভিযুক্ত, তার সম্ভাব্য শাস্তির সমান, বা তারও বেশি বন্দিদশা ভোগ করছেন। এই সত্যকে মনে করিয়ে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে যে, প্রতিটি রাজ্যে জামিনের শর্ত পালনে অক্ষম বন্দিদের খুঁজে বার করতে হবে, এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা জামিনের যোগ্য, তাঁদের এখনই জামিন দিতে হবে। অন্য দিকে, এমন বন্দিও রয়েছেন, যাঁদের ‘অপরাধ’ রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে অঙ্গুলিনির্দেশ। তাঁদের হয়রান করার অস্ত্রও বারে বারে জামিনের আবেদন নাকচ করা। জামিন দানের পরিস্থিতি বিষয়ে চার মাসের মধ্যে সব হাই কোর্টকে, এবং রাজ্য সরকারকে হলফনামাও পেশ করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
বিচারাধীন অবস্থায় দীর্ঘ কারাবাসের অন্যায্যতা বহু আলোচিত। কিন্তু শীর্ষ আদালত যথার্থই মনে করিয়েছে যে, এর দু’টি দিক রয়েছে। এক, পুলিশের অকারণ গ্রেফতার; দুই, আদালতগুলির অকারণে জামিন নাকচ। জামিন-যোগ্য ধারায় অপরাধ ঘটে থাকলেও সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার বিষয়ে পুলিশের বিবেচনাই শেষ কথা। আইনের নির্দেশ হল, গ্রেফতার নিতান্ত আবশ্যক হলে, এবং অভিযুক্ত পুলিশের তদন্তে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করলে বা অনিচ্ছা দেখালে, তবেই তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করবে। কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পুলিশ এই শর্তগুলি যথেচ্ছ লঙ্ঘন করছে। অথচ, বিধিসম্মত তদন্তের দ্বারা অপরাধের কিনারা করার কাজে ফাঁক থাকছে, তাই ভারতে ফৌজদারি ধারায় অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ ও শাস্তিদানের হার লজ্জাজনক। সেই জন্যই আদালতগুলিও জামিনের আবেদনের বিবেচনা করে অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে। শীর্ষ আদালত মনে করিয়েছে যে, আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিদানের বিকল্প হিসেবে জামিন নাকচের কোনও স্থান নেই— জামিনের আবেদন মঞ্জুর করার শর্তগুলি সম্পূর্ণ আলাদা। আদালতকে আইন মেনে চলতে বলার মধ্যে গণতন্ত্রের কতখানি দুর্ভাগ্য নিহিত, তা ভেবে দেখার মতো।
দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষে শীর্ষ আদালতকে মনে করাতে হল যে, ভারত গণতন্ত্র, পুলিশ-রাষ্ট্র নয়। আদালত এবং পুলিশ, ন্যায় বিধানের দুই প্রতিষ্ঠানকেই আপন সীমার মধ্যে থাকতে, এবং নাগরিকের স্বাধীনতার সম্মান করতে নির্দেশ দিতে হল। সেই সঙ্গে আইনসভাকেও সচেতন করতে হল তার কর্তব্যের প্রতি। অর্থাৎ, নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার কর্তব্যের প্রতি রাষ্ট্রের সব ক’টি স্তম্ভকে সজাগ করল শীর্ষ আদালত। আক্ষেপ একটাই— জনগণের নির্বাচিত সরকারই যখন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চায় ফৌজদারি আইনকে, তখন এমন সতর্কতার বাণী কতটুকু গুরুত্ব পাবে? সংবেদনশীল আইন প্রণয়নের, এবং আইন অতিক্রম না করার এই নির্দেশ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে সংশয় রয়েই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy