বহু দিন ধরেই এ দেশে, এবং এই রাজ্যে, রাজনীতির ভাষায় সৌজন্য, সুরুচি বা সভ্যতার নজির ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে চলেছে। অধুনা কুবাক্যের দাপট এমন একটা মাত্রায় পৌঁছেছে যে, নেতানেত্রীরা জনসভায় ভদ্রভাষায় ও সংযত কণ্ঠস্বরে কথা বললে বিস্ময়ের কারণ ঘটে, কুনাট্যে অভ্যস্ত শ্রোতারা অনেকে হয়তো বা সেই ভাষণ শুনতে আগ্রহও হারিয়ে ফেলেন। পরুষভাষণের এই ব্যাধি আজ আর ব্যতিক্রম নয়, কার্যত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, দল এবং প্রশাসনের উপরমহলে, এমনকি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত মহারথীরাও যত্রতত্র অম্লানবদনে বিবিধ বর্গের গরল নিক্ষেপ করে চলেছেন। কিন্তু এই সার্বিক অসৌজন্যের মাপকাঠিতেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের শীর্ষদেশ ও তার সন্নিহিত মহল থেকে সম্প্রতি এমন কিছু উক্তি শোনা গিয়েছে, যা কেবল আপত্তিকর নয়, গভীর উদ্বেগের কারণ। সেই উক্তির লক্ষ্য রাজ্যের উচ্চ আদালত। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় কলকাতা হাই কোর্ট প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার রায় দেওয়ার পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আদালত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তার জন্য কেন তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে আইনি ব্যবস্থা করা হবে না, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যেই আদালতের কাছে পেশ করা হয়েছে। তাঁর অন্যতম প্রধান সহযোগী হিসাবে পরিচিত, শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকও হাই কোর্ট সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য উচ্চারণ করেছেন, সেই উক্তিও অচিরেই আদালতের বিবেচনায় এলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আদালত অবমাননার আইনি বিচারের কাজ মহামান্য আদালতের। এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত বা অভিমত জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আইনি বিচারের বাইরে নৈতিকতার যে পরিসর, সেখানে এই ধরনের অসংযত ও দুর্বিনীত মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা ও তীব্র প্রতিবাদ করা যে কোনও সুস্থ সমাজের দায়িত্ব। প্রশ্ন কেবল সভ্যতা বা সৌজন্যের নয়, প্রশ্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্যরক্ষারও। যে মূল স্তম্ভগুলির উপর গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে থাকে, বিচারব্যবস্থার মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য তাদের অন্যতম। প্রশাসনের চালকদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে সেই মর্যাদা রক্ষা করা। আদালতের নির্দেশ সরকারি কর্তা বা দলীয় নেতাদের পছন্দ না হতেই পারে, কিন্তু সেই বিরাগের কথা জানাতে গিয়ে এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে অসংযত ভাষায় আদালতের প্রতি অশ্রদ্ধা নিক্ষেপ করার ‘স্বাধীনতা’ তাঁরা কখনওই নিতে পারেন না। মুখ্যমন্ত্রী যদি ভেবে থাকেন যে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আস্থা জানিয়ে তিনি আপন কটূক্তির অনৈতিকতা লাঘব করতে পারবেন, সেই ভাবনা ঘোরতর অবিবেচনার পরিচায়ক, হয়তো লজ্জাকর অজ্ঞতারও।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আদালতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপত্তি বা সমালোচনায় কোনও বাধা নেই, তেমন ভিন্নমত বহু ক্ষেত্রেই প্রকাশ করা হয়ে থাকে। শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ক মামলায় বিচারপতিদের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ, নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত নিয়েও বহু তর্ক হয়েছে, হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক চাকরি বাতিল করার সাম্প্রতিকতম নির্দেশটি নৈতিকতা বা ‘স্বাভাবিক ন্যায্যতা’র (ন্যাচারাল জাস্টিস) মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে কি না, সেই প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট যুক্তি আছে। কিন্তু, প্রথমত, সেই প্রশ্ন যুক্তির ভাষাতেই তুলতে হবে, অসংযত ক্রোধের ভাষায় নয়। দ্বিতীয়ত, প্রতিবাদের ভাষা ও ভঙ্গি সংযত রাখার বিষয়ে অন্যদের তুলনায় শাসকদের, বিশেষত বড় মাপের নেতা-মন্ত্রীদের বাড়তি দায়িত্ব আছে। তাঁদের ক্ষমতা ও অধিকার বেশি বলেই দায়িত্বও বেশি। এটাই বড় রকমের উদ্বেগের কারণ যে, এ-রাজ্যের মহারথীরা সেই দায়িত্ব ক্রমাগত লঙ্ঘন করেন, হয়তো স্বীকারই করেন না। শাসকের এই আচরণ দুঃশাসনের পরিবেশ রচনা করে। সেই পরিবেশ এক বার রচিত হলে তাকে সুশাসনে ফেরানো যে কতখানি কঠিন, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ তার দৃষ্টান্ত। চরম দৃষ্টান্ত বললেও অত্যুক্তি হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy