২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ২৪-২৫ বছরের মেয়েদের মধ্যে ৪১.৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে আঠারো বছরের কম বয়সে। প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ নিয়ে অযথা বিতর্ক তৈরি করে মূল প্রশ্নটি এড়াতে চাইছে রাজ্য সরকার। নাবালিকা বিবাহ রুখতে ব্যর্থতার জন্য জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন রাজ্যের কাছে জবাব চেয়েছে। তৃণমূল সরকারের অভিযোগ, বিরোধী-শাসিত রাজ্য বলেই পশ্চিমবঙ্গকে সমালোচনার লক্ষ্য করছে জাতীয় কমিশন। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় নাবালিকা বিবাহের হারে পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত অবস্থান কী, সে প্রশ্নও তুলেছে রাজ্য। জাতীয় কমিশনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যেতেই পারে। সরকারি অথবা স্বায়ত্তশাসিত, যে কোনও প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি সিদ্ধহস্ত। তবে আসল প্রশ্ন অন্যত্র— পশ্চিমবঙ্গের একটি মেয়েরও কেন আঠারো বছর বয়সের আগে বিয়ে হবে, কেন তার শৈশব-কৈশোর সার্থক হবে না? কেন তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে পারছে না রাজ্য? জাতীয় কমিশন কার্যত এই প্রশ্নই তুলেছে। রাজ্য সরকারের প্রেরিত তথ্য বিশ্লেষণ করে কমিশন দেখেছে, এপ্রিল ২০২১ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২— এই সময়সীমার মধ্যে ১৬৩০টি বাল্যবিবাহ সংঘটিত হতে দেখেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। এমনকি এফআইআর-ও পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ জানতে চেয়ে পুলিশের ডিজি-র কাছে চিঠি দিয়েছে জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন। অতএব গোপন অভিসন্ধি থাক বা না থাক, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কতটা তৎপর, সে প্রশ্ন তুলে কমিশন ভুল করেনি, আপন কর্তব্যই পালন করেছে।
বরং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং প্রশাসনিক আধিকারিকরা নাবালিকা বিবাহের প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমের কাছে যে কথাগুলি প্রায় নিয়মিত বলে চলেছেন, সেগুলির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যেমন, এ রাজ্যের মেয়েরা স্বাধীনচেতা, তাই তারা নিজেরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এ কথা মানা যেত, যদি স্বনির্বাচিত সঙ্গীকে বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে পালাতে, আইন ভাঙতে তারা বাধ্য না হত। নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা দাবি করেছেন, অন্য রাজ্যগুলি বাল্যবিবাহের সম্পূর্ণ নথি রাখে না, পশ্চিমবঙ্গে তা রাখা হয় বলেই এ রাজ্যে বাল্যবিবাহের হার বেশি বলে মনে হয়। এই দাবি মানা কঠিন, কারণ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষাও পশ্চিমবঙ্গকে উদ্বেগজনক স্থানে রেখেছে। এই সর্বভারতীয় নমুনা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ২৪-২৫ বছরের মেয়েদের মধ্যে ৪১.৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে আঠারো বছরের কম বয়সে। ২০১৫-র সমীক্ষায় পরিসংখ্যান একই ছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি রিপোর্ট (২০২২) অনুসারে, নাবালিকা বিবাহে দেশের শীর্ষে ঝাড়খণ্ড, দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। নাবালিকার গর্ভধারণ এবং অকাল মাতৃত্বের হারেও পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে, অথবা তার কাছাকাছি, বলছে নানা সমীক্ষা।
কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথীর মতো প্রকল্পে রাজ্যের বিপুল খরচের পরেও এই ব্যর্থতা কেন, সে প্রশ্ন রাজ্য সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। সেই অস্বস্তি ঢাকা দিতেই কি জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সদস্যদের প্রতি রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন বার বার প্রায় মারমুখী হয়ে উঠছে? কোনও তদন্তে জাতীয় কমিশনের সদস্যরা এ রাজ্যে এলেই নানা ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। এটা রাজ্যের লজ্জা। প্রশ্নকর্তাকে খারিজ করে তার প্রশ্ন বাতিল করার চেষ্টা অতি পরিচিত কৌশল। দলীয় রাজনীতির এই খেলায় রাজ্যের নাবালকদের টেনে আনা চলে না। বাল্যবিবাহের হারে অপর রাজ্যে পরিস্থিতি কেমন, জাতীয় গড়ের সাপেক্ষে এ রাজ্য কোথায়, সে প্রশ্ন উঠতে পারে কেবল রাজ্য সরকারের নীতির মূল্যায়নের সময়ে। বিভিন্ন নীতির কোনটি অধিক কার্যকর হচ্ছে, সেই প্রশ্নে। একটিও নাবালিকার বিবাহ যত দিন এ রাজ্যে ঘটবে, তত দিন প্রশাসনিক ব্যর্থতার জবাবদিহি করতে হবে রাজ্য সরকারকে। কেবল কেন্দ্রের কাছে নয়, রাজ্যবাসীর কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy