বাইরন বিশ্বাস। ফাইল চিত্র।
বাইরন বিশ্বাস ইতিহাসে দাগ রাখলেন। কলঙ্কের দাগ। এ দেশে এবং এই রাজ্যে যথেচ্ছ দলবদলের আধুনিক কুনাট্যের পরম্পরায় মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির বিধায়ক এক নতুন মাত্রা সংযোজন করতে সফল হয়েছেন। বিরোধী কংগ্রেসের প্রার্থীর ভূমিকায় মঞ্চে নেমে শাসক দলের বিরুদ্ধে রকমারি কটূক্তি সহকারে প্রচার চালিয়ে উপনির্বাচনে জয়ী হওয়ার তিন মাসের মধ্যে শ্রীযুক্ত বিশ্বাস সেই দলের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে ঘোষণা করলেন— তিনি তৃণমূল কংগ্রেসেরই লোক ছিলেন এবং তাঁর জয় ব্যক্তিগত সাফল্য, এতে কংগ্রেসের কোনও অবদান ছিল না! যে দলের প্রার্থী হিসাবে তিনি ভোট চেয়েছিলেন তার প্রতি দায়বোধের প্রশ্ন ছেড়েই দেওয়া গেল। কিন্তু ভোটদাতারা তাঁকে একটি দলের প্রতিনিধি হিসাবেই ভোট দিয়েছিলেন; কার্যত নিমেষের মধ্যে সেই জনাদেশকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করতে এবং এতদ্দ্বারা জনসাধারণের চরম অমর্যাদা ঘটাতেও এই রাজনীতি-পসারির চক্ষুলজ্জাটুকুরও চিহ্ন দেখা গেল না। নীতিহীনতা এবং নির্লজ্জতা সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেলে নিন্দা বা সমালোচনার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অবশ্য সত্য সত্যই দু’কান কেটে ফেলতে পারলে সমস্ত নিন্দার ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া যায়। বাইরন বিশ্বাস সেই উত্তরণের মূর্ত প্রতীক।
কিন্তু এই অতুল কীর্তি তাঁর একার নয়। সোমবার তৃণমূল কংগ্রেস নামক যে দলটিতে তিনি পরম উল্লাসে যোগ দিলেন এবং ‘নব জোয়ার যাত্রা’র অবকাশে যে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তাঁকে পরম আহ্লাদে বরণ করে নিলেন, এই কলঙ্কের চিহ্ন তারও সর্বাঙ্গে নতুন করে প্রকট হয়ে উঠল। জনতার আদালতে এই অপরাধের কোনও বিচার হবে বা হবে না, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু বিরোধী জনপ্রতিনিধি তথা রাজনীতিকদের গ্রাস করে নেওয়াই শাসকের ধর্ম হয়ে দাঁড়ালে নির্বাচনের আর কোনও অর্থ থাকবে কি? এই বিষয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, তাঁরা দল ভাঙাননি, বাইরন নিজে যোগাযোগ করেছেন, তা না হলে সাগরদিঘির বিধায়ক ঘাটালে এসে ঠিকানা বদলাবেন কেন? এমন ছেঁদো কথায় ঘোড়াও হাসবে না। আবার এরই পাশাপাশি তাঁর ঘোষণা: তাঁরা সঙ্কেত দিলেই কংগ্রেসের চার জন সাংসদ তৃণমূলে চলে আসবেন। এই উক্তিতে কেবল বিপুল ঔদ্ধত্যই প্রতিফলিত হয়নি, নিরাবরণ হয়েছে রাজনীতি থেকে ন্যূনতম নৈতিকতাটুকুও বিসর্জন দেওয়ার ভয়াবহ মানসিকতা। নেতা-মন্ত্রীদের অবিরত শিবির-বদলের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই মানসিকতাই বারংবার প্রতিফলিত হয়েছে। বাইরন বিশ্বাসের বিচিত্রকাণ্ড দেখিয়ে দিল, সেই ট্র্যাডিশন সমানেই চলবে।
প্রশ্ন কেবল নৈতিকতার নয়, বাস্তব রাজনীতিরও। ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করার স্বার্থে বিরোধী ঐক্যের যে উদ্যোগ চলছে, পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র কংগ্রেস বিধায়ককে তড়িৎগতিতে আত্মসাৎ করে নেওয়ার এই আগ্রাসী পদক্ষেপে নিঃসন্দেহে সেই উদ্যোগের বড় রকমের ক্ষতি হল। কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বোঝাপড়া যে অতি কঠিন, রাজ্যের রাজনীতি এবং সর্বভারতীয় রাজনীতির বাস্তবকে মেলানোর জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়ানোর দরকার, সে কথা বহুচর্চিত। তার উপায় সন্ধান করাই এখন একটি বড় কাজ। কিন্তু সম্পূর্ণ অনৈতিক ভাবে কংগ্রেসকে আক্ষরিক অর্থে মুছে দেওয়াই যদি রাজ্যের শাসক দলের নীতি হয়, তার পরে আর বোঝাপড়ার কোনও সম্ভাবনা আদৌ অবশিষ্ট থাকে কি? সোমবারের ঘটনার পরে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে আবারও চেনা অভিযোগ শোনা গিয়েছে: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির সুবিধা করে দিচ্ছেন। এই অভিযোগের নানা বাস্তব কারণ আগেও ছিল, এ বার তা বহুগুণ বেশি জোরদার হয়ে উঠল। প্রসঙ্গত, বাইরন বিশ্বাস-কাণ্ড সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী এবং দলের সর্বাধিনায়িকা বলেছেন: ‘জানি না’। ডি এল রায়ের জাহানারা অবশ্যই নিক্ষেপ করবেন তাঁর সেই তীব্র ভর্ৎসনা: আবার বলি, চমৎকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy