—ফাইল চিত্র।
ভোটের মরসুম। সুতরাং ভারতের আকাশে (অপ)প্রচারের ঘনঘটা, বাতাসে (অপ)ভাষার। রাজনীতিকদের উগ্রভাষণে রাজ্যবাসী অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, এখন অন্য রকম শুনলেই তাঁরা অবাক হন। কিন্তু মঙ্গলবার এই অবিরত কুনাট্যের এক নতুন রূপ দেখা, শোনা গেল আকথার পিঠে কুকথা মিলে যাওয়ার এক চমকদার ও ভীতিপ্রদ যুগলবন্দি। কেন্দ্রীয় শাসক দলের দুই মহারথী সে দিন পশ্চিমবঙ্গে পদার্পণ করেছিলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। পূর্ব বর্ধমানের মেমারিতে নির্বাচনী জনসভার ভাষণে রাজ্যের শাসকদের দুর্নীতি নিয়ে পরিচিত হুঙ্কারের মধ্যে শোনা গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তা: “তিরিশটা আসন জিতিয়ে দিন; যারা পয়সা খেয়ে নিয়েছে, উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করবে বিজেপি।” অন্য দিকে, বীরভূমের সিউড়িতে নির্বাচনী জনসভার মঞ্চ থেকে যোগীবর ঘোষণা করলেন: “রামনবমীর শোভাযাত্রায় সংঘর্ষ ও ভাঙচুর করার সাহস যদি কেউ উত্তরপ্রদেশে দেখাত, তা হলে তাকে উল্টো করে টাঙিয়ে তার পুরো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হত।” দুই জেলা, দুই মঞ্চ, দুই বক্তা, দুই উপলক্ষ, কিন্তু বিধান এক এবং অদ্বিতীয়: উল্টো করে ঝুলিয়ে/টাঙিয়ে দেওয়া। যেন দুই দাপুটে মানিকজোড়ের নিপুণ সওয়াল-জবাব।
পরাক্রমী শাসক শিবিরের দুই পরাক্রমী নেতার মুখে হুবহু একই ভাষায় উচ্চারিত এই হুমকি বোধ করি তাঁদের অন্তরলোকের চেহারা-চরিত্রটিকেই জনসমক্ষে উদ্ঘাটিত করে দেয়। ক্ষমতার রাজনীতি, ক্ষমতা দখলের রাজনীতি তাঁদের চিন্তা ও চেতনাকে এমন ভাবেই গ্রাস করে ফেলেছে যে স্বাভাবিক ভদ্রতা বা বাক্সংযমের বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁদের নেই, সে-কথা আজ সর্বজনবিদিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন নিছক বাক্সংযমের নয়, মনের কথা ভদ্রতার খাতিরে মনে রেখে দেওয়ার প্রশ্ন নয়। কেমন সেই মন, যেখানে প্রতিপক্ষকে সতর্ক করার বা ভয় দেখানোর লক্ষ্যে ‘উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া’র কথা জন্মায় ও লালিত হয়? দু’জনের মুখে একই অপভাষার এই সমাপতন জানিয়ে দেয়, এই কালব্যাধি ব্যক্তিগত নয়, এর গভীরে আছে উগ্র অসহিষ্ণু আধিপত্যবাদের সংক্রামক জীবাণু, যা ক্রমাগত ভয়াবহ ভাবে নিজেকে প্রকট ও প্রকাশ করতে থাকে।
কেবল এই দুই নেতা নয়, কেবল কেন্দ্রীয় শাসক শিবিরের বিবিধ মাপের নেতা ও নেত্রীরাই নন, অন্য নানা দলের নানা চরিত্রের মুখেও এই ধরনের আক্রমণ বিরল নয়। স্পষ্টতই, দলের অধিনায়ক বা অধিনায়িকারাও এমন উক্তিতে অন্যায় কিছু দেখেন না, বরং ‘ভোটের সময় ও সব বলতে হয়’ গোছের ‘যুক্তি’ দিয়ে থাকেন। এবং, সবচেয়ে বড় উদ্বেগ এখানেই যে ক্রমশ সমাজও এই সব গরল সেবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আজ থেকে দু’এক দশক আগেও এ-কথা ভাবা কঠিন ছিল যে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বৃহত্তম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একযোগে এমন ভয়াবহ বাক্য উচ্চারণ করছেন। কিন্তু আজ সেটাই ঘটছে এবং তা নিয়ে বঙ্গীয় সমাজেও কোনও তাপ-উত্তাপ দেখা যাচ্ছে না, অনেক কথার ভিড়ে এই উচ্চারণও বেমালুম হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যেতে পারছে। রাজনীতির অনুশীলনে যে হিংস্রতা প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান, তার শিকড় রয়েছে রাজনীতিকদের মনের গভীরেই। রাঢ়বঙ্গের জনসভায় সেই সত্যই ফাঁস হয়ে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy