পাকিস্তানের প্রাক্তন সেনানায়ক ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ় মুশারফ। ছবি: পিটিআই।
দেশভাগের পর মহম্মদ আলি জিন্না বেশি দিন বাঁচেননি। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে একটা কথা বহু বার বলেছেন। বলেছেন যে, ভারত আর পাকিস্তান যদি অতঃপর পরস্পরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক না তৈরি করে, দুই দেশেরই বিপদ গভীর ও ব্যাপক। অসুস্থ ভগ্নমনোরথ জিন্না হয়তো একটি কথা ভুলে বসেছিলেন এই সময়। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক আসলে অনেক সময়ই অসহযোগিতার, অমৈত্রীরও। সংঘাত আর দ্বন্দ্বের পরিমাণ ভাইদের মধ্যে কম নয়, বিশেষত তাদের মধ্যে যদি থাকে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের সেই ‘ভ্রাতৃত্ব’-সম্পর্কের বিবিধ আখ্যান রচনা করে আসছে জন্ম ইস্তক, সন্দেহ নেই। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রাক্তন সেনানায়ক ও প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ় মুশারফের মৃত্যুর পর আবার এখন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন বিতর্কের মধ্যে। মুশারফের পাকিস্তান কি ভারতের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন ছিল, না কি চরম শত্রুতাই করেছিল: এ তর্ক বিশেষ ভাবে জমার কারণ, মুশারফের শাসনকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ী, যাঁর সময়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বিশেষ উন্নতি হয়েছিল এবং কাশ্মীর সঙ্কট সমাধানের দিকে এগোনো গিয়েছিল বলে মনে করা হয়।
এই বিতর্কের কেন্দ্রে অবশ্য কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের একটি মন্তব্য। তারুর বলেছেন মুশারফ কার্গিল পর্বে ভারতের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হলেও পরবর্তী কালে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। বর্তমান বিজেপি সরকারের কাছে পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনও সুসম্পর্কের উল্লেখই দেশদ্রোহের শামিল। তার উপর বিজেপির পূর্বতন জমানায় পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি-প্রচেষ্টার কথা আগুনে ঘৃতাহুতির মতো। ফলে সমালোচনার বন্যা ধেয়ে গিয়েছে তারুরের প্রতি। তারুর স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি এমন সংস্কৃতি থেকে আসেন যেখানে প্রয়াণোত্তর কালে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করাই রীতি। মুশারফ কার্গিল যুদ্ধের স্থপতি ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিতে বিশেষ প্রয়াসী ছিলেন মুশারফ, এটাই তারুরের সুবিবেচিত মত।
কার্গিল যুদ্ধের ঘটনাবলি দেশবাসীকে নতুন করে মনে করানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু সম্ভবত মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি যে, এমন একটি সংঘর্ষের মাত্র দুই বছরের মাথায়, আগরা শহরে দুই দেশের শীর্ষ বৈঠক সংঘটিত হয়েছিল, যেখানে মুশারফ, বাজপেয়ীর সঙ্গে লালকৃষ্ণ আডবাণীও একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইতিমধ্যে ৯/১১ ঘটে গিয়েছে, সীমান্তের দুই দিকেই সন্ত্রাস-বিরোধী কার্যক্রমের চাপ যথেষ্ট। দুই দেশের শীর্ষ নেতারা কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অস্ত্রসংবরণ ও শান্তি রক্ষার উপর বিশেষ জোর দিচ্ছিলেন। জম্মু ও কাশ্মীরে স্বশাসনের মডেলটিকে ভারত-পাক যৌথ উদ্যোগে কার্যকর করার কথা ভাবছিলেন। শেষ অবধি এ সব ফলপ্রসূ না হলেও এই সম্ভাবনা যে তৈরি হয়েছিল, সেটাও কম কথা নয়। এর পর প্রেসিডেন্ট মুশারফ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নানা সঙ্কটে জড়িয়ে পড়েন, ২০০৭ সালের জুলাই মাসে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে জঙ্গি-দমন অভিযান চূড়ান্ত ক্ষুব্ধ করে পাক সমাজকে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সঙ্গে তাঁর সরাসরি সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। দেশের বাইরে স্বেচ্ছানির্বাসনে যেতে বাধ্য হন মুশারফ। তবু ভোলা যাবে না যে, ২০০৭ অবধি তাঁর বিরুদ্ধে একটি বিশেষ অভিযোগ ছিল দিল্লির সঙ্গে তাঁর সহযোগিতার মনোভাব। আজ ভারতীয় সরকার যে প্রচারই করুক, নিরপেক্ষ তথ্য বলবে, মুশারফ ভারতের সঙ্গে সৌহার্দের চেষ্টা করেছিলেন— কোনও বন্ধুত্ব কামনায় নয়, বরং পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক কৌশলের কথা ভেবেই। ভারতবন্ধু হিসাবে মুশারফকে বর্ণনা না করলেও চলবে। কৌশলী দ্বিপাক্ষিকতার সম্ভাব্য স্থপতি ছিলেন তিনি, এইটুকুই যথেষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy