এলগার পরিষদ সংক্রান্ত মামলায় ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে কারাবন্দি ছিলেন নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সোমা সেন। —ফাইল চিত্র।
মাওবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে এলগার পরিষদ সংক্রান্ত মামলায় ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে কারাবন্দি ছিলেন নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সোমা সেন। ছ’বছর পূর্ণ হওয়ার অল্পকাল আগে গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেছে। সর্বোচ্চ আদালতের বক্তব্য: তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ‘প্রাথমিক ভাবে’ (প্রাইমা ফেসি) যথাযথ মনে করার কোনও কারণ নেই। জামিন দেওয়া যায় না এমন কোনও অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নেই— ইউএপিএ নামক কঠোর আইন মোতাবেকও নয়। এই পর্যবেক্ষণ সর্বোচ্চ আদালত করেছে যে, তাঁর বয়স এবং ভঙ্গুর স্বাস্থ্য মনে রেখেও তাঁকে জামিন দেওয়া উচিত। তাঁকে বন্দি করারই কোনও প্রয়োজন ছিল না, এনআইএ রিপোর্ট থেকে নাকি তা স্পষ্ট। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, ছয় বছর সময় ধরে তা হলে ঠিক কী ঘটছিল? সোমা সেনকে এত দিন জেলে কাটাতে হল কেন? জাতীয় তদন্ত সংস্থা বা এনআইএ-র ডাকসাইটে তদন্তকারীরা ছ’বছর বা ছ’শো বছর ধরে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ বা নির্মাণের কাজ চালাতে পারেন, কিন্তু সে জন্য এক জন নাগরিককে সুদীর্ঘ কাল জেলে কাটাতে হবে? সুপ্রিম কোর্টের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও মন্তব্যের পরে এই প্রশ্ন অনিবার্য নয় কি?
সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নও অনিবার্য যে, এই চূড়ান্ত অবিচারের পিছনে রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকদের ভূমিকাটি ঠিক কী। এক দিকে তাঁরা অহেতুক অতিরিক্ত দমনমূলক আইন বানাতে তৎপর, অন্য দিকে আইনের প্রয়োগেও প্রতিপক্ষকে নিপীড়নের জন্য সর্বপ্রকারে যত্নবান। এত দিনে গোটা দেশের নাগরিক সমাজের কাছে পরিষ্কার— জামিন নামক ব্যবস্থাটি আপাতত প্রশাসনের হাতে নিপীড়নের অস্ত্রবিশেষ। ইউএপিএ-র মতো আইনে জামিন পাওয়ার পথটিই দুস্তর, এবং সম্পূর্ণ অন্যায় ভাবে এই আইন প্রয়োগ করা প্রশাসনের অভ্যাসে পরিণত। কিন্তু সাধারণ ভাবেই, চিহ্নিত অভিযুক্তের জামিনের বিরোধিতা করা, একটি মামলায় জামিন পেলে অন্য মামলা জারি করে আটক রাখার তৎপরতা, জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন দেখিয়ে সুদীর্ঘ কাল অভিযুক্তকে আটকে রাখা— এ-সবই এ দেশে অতি পরিচিত প্রশাসনিক কার্যক্রম। এই দুঃশাসন নতুন নয়, কিন্তু গত দশ বছরে— বিরোধী বা ভিন্ন মত দমনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের অঙ্গ হিসাবেই— তা এক অস্বাভাবিক মাত্রা অর্জন করেছে। কেবল কেন্দ্রীয় স্তরে নয়, অনেক রাজ্যেও। প্রসঙ্গত, সর্বোচ্চ আদালত ২০২২ সালের একটি নির্দেশিকার সূত্র ধরে সম্প্রতি জানতে চেয়েছে, দ্রুত জামিন দেওয়ার জন্য বিশেষ আইন প্রবর্তনের কোনও উদ্যোগ সরকার করছে কি না।
প্রশ্নটি কেবল এই একটি মামলার ক্ষেত্রে নয়, বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতেই ‘বেল’ বা জামিনের বিষয়টি নিয়ে বহু দিন ধরে বহু তর্কবিতর্ক চলেছে। সুপ্রিম কোর্ট বহু দিন ধরেই বারংবার বলেছে, ভারত কোনও পুলিশি রাষ্ট্র নয়, এখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ‘জেল নয়, বেল-ই নিয়ম হওয়া উচিত’। অথচ কার্যক্ষেত্রে যে ভাবে অভিযুক্তদের জামিন না দিয়ে হাজতে পাঠানো হয় এবং যে ভাবে সুদীর্ঘ কাল ধরে তাঁদের কারারুদ্ধ করে রাখা হয়, তাতে ওই আদর্শের ঠিক উল্টো রীতিই যেন কার্যকর হয়ে ওঠে। লক্ষণীয়, গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অভিযুক্তরা জামিন পেয়েছেন, অনেকেই দীর্ঘ কারাবাসের পরে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির গতি আজও নিতান্তই শ্লথ। তার অর্থ: অবিচারের ধারাটি আজও অব্যাহত, কারণ, বিচারাধীন অভিযুক্তদের একান্ত প্রয়োজনের তুলনায় এক দিনও বেশি বন্দি রাখা অবিচারের নামান্তর। সোমা সেনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যের কল্যাণে সেই প্রশ্নটি আরও এক বার অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠল। তবে, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় যাঁদের, তাঁরা আপাতত দেশ জুড়ে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাতে ব্যস্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy