Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Indian National Congress

কাকে বলে ইতিহাস

তামিলনাড়ুতে ইতিহাস চর্চার বৈঠক হচ্ছে, এর থেকে উপযুক্ত মুহূর্ত আর কী-ই বা হতে পারে এমন অভিপ্রায় পেশ করার— মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিনের মন্তব্য।

 তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন।

তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন। ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৩৮
Share: Save:

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত একাশিতম ইতিহাস কংগ্রেসে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন দু’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বলেছেন, প্রথমত, ইতিহাসকে অনবরত ‘বিকৃত’ ও ‘সাম্প্রদায়িক রঙে রাঙানো’ থেকে বিরত থাকতে হবে এই দেশকে। এবং খুব ভাল হয়, যদি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস আবার নতুন করে লেখা হয় দক্ষিণী দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশেষত তামিল দৃষ্টিকোণ থেকে। তামিলনাড়ুতে ইতিহাস চর্চার বৈঠক হচ্ছে, এর থেকে উপযুক্ত মুহূর্ত আর কী-ই বা হতে পারে এমন অভিপ্রায় পেশ করার— মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিনের মন্তব্য। প্রাথমিক ভাবে শুনলে মনে হতে পারে, আরও এক বার আঞ্চলিক সঙ্কীর্ণতার গন্ধ আসছে এমন দাবি থেকে। কিন্তু আঞ্চলিক অস্মিতার সস্তা বিজ্ঞাপনের বাইরেও তাঁর এই দাবির একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপট আছে। স্ট্যালিনকে সাধুবাদ জানাতে হয় তিনি সেই প্রেক্ষাপটটি যথেষ্ট সঙ্গত ও যথার্থ ভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন বলে। পেশাগত ভাবে যাঁরা ইতিহাস চর্চা করেন, তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে উপযুক্ত গভীরবীক্ষণের সঙ্গে তিনি বলেছেন, ইতিহাস তো কেবল রাজারাজড়াদের কাহিনি নয়, যুদ্ধে জয়পরাজয়ের তালিকাও নয়। ইতিহাসের অর্থ, যে কোনও ভুবনের মানুষের জীবনযাপনকে প্রতিফলিত করা— তার বিকৃত বিশ্লেষণ দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থপূরণ যাঁরা করেন, তাঁদের হাত থেকে ইতিহাসের স্বত্ব সরিয়ে নিতে হবে! এই প্রসঙ্গেই তামিলনাড়ুর মতো সংস্কৃতিসমৃদ্ধ অঞ্চলের মানসিক ও মানবিক ইতিহাসের আরও গুরুত্ব পাওয়া উচিত— এটাই স্ট্যালিনের বার্তা। বাস্তবিক, কেন্দ্রীয় বন্দোবস্তে ভারতের যে ইতিহাস দেশব্যাপী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়তে হয়, তার মধ্যে দক্ষিণ ভারতের এই সংস্কৃতির স্থান অতি সামান্যই। সুতরাং, তামিল মুখ্যমন্ত্রীর দাবিটিতে যদি কোনও ক্ষোভের স্বর থাকে, তা কেবল একটি রাজ্যের অধিবাসী সমাজ থেকে উত্থিত নয়, বরং তার মধ্যে ভারতের বিস্তৃত দক্ষিণাংশের বহুকাল যাবৎ সঞ্চিত গভীর অভিমানের রেশ টের পাওয়া সম্ভব।

লক্ষণীয়, মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিনের তোলা দু’টি দাবির মধ্যে এক গভীর যোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক ধারা অনুযায়ী ভারতের ইতিহাস যদি গোবলয়জ হিন্দুত্বের বিপন্নতা ও গৌরবগাথার ঢঙে লেখা হতে থাকে— তা হলে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসকে তার মধ্যে প্রতিফলিত করা দুরূহ হবেই। দক্ষিণ ভারতের হিন্দু বা মুসলমান কোনও সম্প্রদায়ের ইতিহাসই উত্তর ভারতের পায়ে পায়ে এগোয়নি। আবিন্ধ্যকন্যাকুমারিকা বরং বহু কাল ধরেই নিজেদের ভিন্নতা বজায় রেখেছে, হিন্দু রাজারা যেমন সেই ভিন্ন সংস্কৃতির গর্বিত ধারকবাহক, মুসলমান সুলতানরাও ঠিক তা-ই। এই জন্য বিনায়ক দামোদর সাভারকর যখন ঔরঙ্গজেব ও টিপু সুলতানকে একাসনে বসিয়ে তাঁদের মুসলমানত্বকে প্রধান করে দেখেন, তার মধ্যে থেকে যায় এক অমার্জনীয় অন্যায়। মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু সে সবের মধ্যে না ঢুকেও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, মহীশূরাধিপতি হায়দর আলি ও টিপু সুলতান ছিলেন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে ভূমিপুত্র সংস্কৃতির ধারকবাহক। আসল কথা, বর্তমান ভারতে হিন্দুত্ববাদের প্রকল্পে ইতিহাসকে কেবল সম্প্রদায়-রঙে রাঙানোই চলছে না, সুবিশাল দেশটির অতি সঙ্কীর্ণ এক অংশের ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে বাকি সব আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতাকে প্রান্তিক করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে।

ইতিহাসচর্চার মধ্যে কেবলই এ ভাবে রাজনীতির অভিসন্ধি খোঁজা বন্ধ হোক। কিছু দিন আগেই ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ইতিহাসের নামে গালগল্প প্রচার করে কী ভাবে মানুষকে বিপথচালিত করা হচ্ছে, প্রশিক্ষিত ইতিহাসচর্চাকে নগণ্য করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রসঙ্গত, যে সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিনের বক্তব্য শোনা গিয়েছিল, সেই একই সময়ে ‘বীর বাল দিবস’ নামক একটি নবনির্মিত হিন্দুভাবসিঞ্চিত উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদীর গলায় শোনা গিয়েছিল ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে গৌরবদীপ্ত ‘নতুন ভারত’ গড়ার ডাক। ভারতীয় ইতিহাসবিদরা কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে চান— না, ইতিহাসের লক্ষ্য ‘গৌরব’ উৎপাদন করা নয়, বরং তার কাজ অতীত কীর্তির সঙ্গে অতীত ভ্রান্তি, দুর্বলতা, পরাজয়, বিভেদ, অন্যায়, এ সবের বিশ্লেষণের মাধ্যমে এক পূর্ণাঙ্গ সামাজিক বোধ তৈরি। সেই বোধে একতা নিশ্চয় জরুরি— যে একতা বিভিন্নতাকে আক্রমণ করে না, বরং মিলিত হতে শেখায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian National Congress Tamil Nadu M K Stalin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy