গ্রামের ৭৬ শতাংশ পরিবারেই রান্না হচ্ছে কাঠকুটো, শুকনো ডালপালা বা খড়কুটো জ্বালিয়ে। ফাইল চিত্র। ফাইল চিত্র।
এই মুহূর্তে গ্রামীণ বাংলায় ৭৬ শতাংশ পরিবার রান্না করছে কাঠকুটো জ্বালিয়ে, জানাল জাতীয় নমুনা সমীক্ষা। এই তথ্য দু’টি কারণে উদ্বেগজনক। প্রথমত, সব ভারতীয় পরিবারের কাছে সুলভে রান্নার গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ‘উজ্জ্বলা’ প্রকল্প, তা অনেকাংশেই পূর্ণ হয়নি। উজ্জ্বলার সূচনার (২০১৬) সময়ের চেয়ে অবশ্যই উন্নতি হয়েছে— ২০১৫-র জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দেখিয়েছিল, গড়ে ভারতের মাত্র ১৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার এলপিজি ব্যবহার করে। এখন গ্রামীণ ভারতের প্রায় অর্ধেক পরিবার এলপিজি ব্যবহার করছে। কিন্তু উজ্জ্বলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র মেয়েদের কাছে স্বচ্ছ জ্বালানি পৌঁছে দেওয়া। সে কাজে প্রকল্পটি কার্যত ব্যর্থ, কারণ দরিদ্রতর রাজ্যগুলিই প্রধানত এলপিজি থেকে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছে। ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ডে দশটি গ্রামীণ গৃহস্থালির বড় জোর তিনটিতে এলপিজি ব্যবহার হচ্ছে। এর বিপরীতে, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশে ৮০ শতাংশেরও বেশি গ্রামীণ গৃহস্থালিতে এখন রান্নার প্রধান জ্বালানি এলপিজি। এর কারণ স্পষ্ট— অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ রাজ্যগুলিতে গ্রামবাসী এগারোশো টাকার বেশি খরচ করে গ্যাস কিনতে পারছে, দরিদ্রতর রাজ্যগুলিতে তাদের সে ক্ষমতা নেই।
উদ্বেগের দ্বিতীয় কারণটি পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। উন্নয়নের বহু মনোহর কাহিনি প্রচার সত্ত্বেও গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গ দেশের দরিদ্রতম এলাকাগুলির অন্যতম, তাই স্বচ্ছ জ্বালানির খরচ জোগাতে গ্রামীণ বাংলার চারটি পরিবারের তিনটিই অপারগ। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছত্তীসগঢ়, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে। ২০২০ সালের মে মাসে এলপিজির দাম আটশো টাকা ছাড়ানোর পরে একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষা দেখিয়েছিল, এলপিজি-কে প্রধান জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করতে হলে গ্রামীণ গৃহস্থালিগুলিকে তাদের মাসিক ব্যয়ের ৮ শতাংশ খরচ করতে হবে। দরিদ্রতম গৃহস্থালিতে খরচ ছাড়াবে ১২ শতাংশ। অতিমারির জেরে রোজগার যখন কমছে, এবং মূল্যস্ফীতির হার অতিক্রম করেছে মজুরি বৃদ্ধির হারকে, তখন দরিদ্র পরিবারগুলি এলপিজির খরচ এড়াবে, তাতে আশ্চর্য কী? ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ৪২ শতাংশ পরিবার অতিমারিতে এলপিজি ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিল, দেখিয়েছিল ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গের দুই গবেষকের একটি ক্ষেত্রসমীক্ষা। রাজকোষের অর্থ খরচ করেও দরিদ্রতম মেয়েদের বিপন্নতা কমল না, বরং অসাম্য বাড়ল, এটা পরিকল্পনার দুর্বলতারই ইঙ্গিত দেয়।
বর্তমানে সরকার ভর্তুকির অঙ্ক স্থির রেখেছে, গ্যাসের দাম রয়েছে পরিবর্তনশীল। ফলে মূল্যবৃদ্ধি থেকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না নিম্নবিত্তকে। আশঙ্কা আরও এই যে, জ্বালানি হিসাবে কাঠকুটোর উপর নির্ভরতা কেবল দারিদ্রের লক্ষণ নয়, তা দারিদ্রের কারণও বটে। জ্বালানি সংগ্রহ, অথবা শস্যের অবশেষ, প্রাণিবর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির ভার পড়ে মেয়েদের উপরেই। বহু বালিকা ও তরুণীর জীবনের মূল্যবান সময় এ কাজে ক্ষয় হয়, নষ্ট হয় তাদের শিক্ষা, উৎপাদনশীলতা। ভারতের শ্রমবাহিনী থেকে মেয়েদের দ্রুত অপসারণের অন্যতম কারণ গৃহকাজের বোঝা, তা প্রমাণিত। জল ও জ্বালানি নীতির ব্যর্থতা সেই বোঝা লাঘব না করে বাড়িয়ে চলেছে। মানবসম্পদের এই অপচয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মন্দ জ্বালানি-জনিত স্বাস্থ্যহানি, প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ। একবিংশের ভারতের প্রতিটি গৃহস্থালিতে স্বচ্ছ জ্বালানি পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, তা থেকে পিছিয়ে আসা চলে না। প্রয়োজন হলে এলপিজির পাশাপাশি ধোঁয়াহীন চুল্লি, জৈবগ্যাস, সৌরশক্তির মতো বিকল্পকে জ্বালানি নীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিতে হবে। ভারতকে কাঠকুড়ানি, গোবরকুড়ানির দেশ করে রাখা কেবল নীতির ব্যর্থতা নয়, সব অর্থেই তা অনৈতিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy