নোটবন্দি সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থ মামলায় কেন্দ্র সর্বোচ্চ আদালতকে জানায় যে, বিষয়টি এখন আর জনজীবনে প্রাসঙ্গিক নয়। ফাইল চিত্র।
দেশের সব কালো টাকা উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই প্রতিশ্রুতি জলে গিয়েছে। কেন গিয়েছে, সেই প্রশ্নটি গত ছ’বছর ধরে তাড়া করে বেড়িয়েছে বিজেপি সরকারকে, যে প্রশ্নের কোনও সন্তোষজনক উত্তর এখনও মেলেনি। এই অক্টোবরে নোটবন্দি সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থ মামলায় কেন্দ্র সর্বোচ্চ আদালতকে জানায় যে, বিষয়টি এখন আর জনজীবনে প্রাসঙ্গিক নয়— ওই ঘটনার পর গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গিয়েছে। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনায় কেন্দ্রীয় সরকারের এ-হেন অনীহাই এই সিদ্ধান্তের ব্যর্থতার মোক্ষমতম প্রমাণ— কারণ, সরকারের চলন থেকে অনুমান করা চলে, সাফল্যের তিলমাত্র থাকলে তার ঢাকের বাদ্যিতে কান পাতা দুষ্কর হত। কিন্তু, এই নেতি-র প্রমাণ যদি কেউ মানতে নারাজ হন, তাঁর জন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণও হাজির— রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যই জানাল যে, নোট বাতিলের চার দিন আগে আমজনতার হাতে যে পরিমাণ নগদ টাকা ছিল, গত ছ’বছরে তার পরিমাণ বেড়েছে ৭১.৮৪ শতাংশ।
নোট বাতিলের সিদ্ধান্তটি মোদীর ‘মাস্টারস্ট্রোক’ কেন, ২০১৬ সালে সরকারি ও সরকার-ঘনিষ্ঠ মহল থেকে দিনে-রাতে তার হরেক তত্ত্ব খাড়া করা হত। তার প্রথমেই ছিল কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতান্ত কাঁচা না হলে বোঝা যেত, কালো টাকার সিংহভাগই মজুত থাকে উৎপাদনশীল সম্পদে, যে সম্পদ সুদ বা লাভ অর্জন করতে পারে। যতটুকু কালো টাকা তোষকের নীচে লুকিয়ে রাখা ছিল, বিভিন্ন পথ ঘুরে তা-ও অর্থব্যবস্থায় ফের ফিরে এসেছে। দ্বিতীয় যুক্তি ছিল, এই ব্যবসায় জাল নোটের ব্যবসা ধ্বংস হবে। মে মাসে প্রকাশিত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০২১-২২’এ জাল নোট ১০.৭ শতাংশ বেড়েছে। সরকার জানিয়েছিল যে, নোট বাতিলের মাধ্যমে ভারতে নগদহীন অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যই বলছে, ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর দেশের জনতার হাতে যেখানে নগদ ১৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা ছিল, সেখানে এই বছরের ২১ অক্টোবর তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা। নোট বাতিলের লাভের পাল্লাটি নিতান্ত ফাঁকা হলেও ক্ষতির বহর বিপুল। ভারতের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্র-নির্ভর অর্থব্যবস্থায়— যেখানে নগদই অর্থনীতির ধমনীর রক্ত— নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত কী বিপুল ক্ষতি করেছে, যাবতীয় পরিসংখ্যান তার সাক্ষ্য বহন করছে।
নোট বাতিলের লাভ-ক্ষতির হিসাব এত দিনে জানা। এ কথাও জানা যে, কোনও বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রীর পরামর্শ মেনে নয়, এত বড় একখানা কাণ্ডের পিছনে ছিল শুধু প্রধানমন্ত্রীর দফতর, এবং অতি ঘনিষ্ঠ কতিপয় পার্ষদের বুদ্ধি। ঘটনার ছ’বছর পূর্তিতে নতুন উপলব্ধি শুধু এটুকুই যে, এ-হেন অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই। দেশের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা দূরে থাকুক, ছ’বছরে তাঁরা এক বারও ভ্রান্তিস্বীকারটুকুও করেননি। স্বভাবগত অস্বচ্ছতায় ঢেকে রাখতে চেয়েছেন প্রকৃত পরিস্থিতি। এতেই আশঙ্কা হয় যে, তাঁরা নিজেদের ভুল থেকে কিছু শেখেননি। শেখেন না। এবং, যাঁরা ভুল থেকে শিক্ষা নেন না, তাঁদের পক্ষে আরও মারাত্মক ভুল করা অস্বাভাবিক নয়। সেই ভুলের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকাই ভারতের নিয়তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy