রসায়নের যে কোনও গবেষণাগারের অপরিহার্য অঙ্গ একটি সারণি— পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি। রসায়ন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাবৎ মৌল ও যৌগের পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া বুঝিবার শাস্ত্র। প্রকৃতিতে মৌল মাত্র শতাধিক, কিন্তু যৌগ অগণ্য। কী প্রকারে মাত্র শতাধিক মৌল একত্রিত হইয়া অগণ্য যৌগ গড়িয়া তুলে, তাহা বুঝিতে ভরসা পর্যায় সারণি। বিজ্ঞানে বহু ক্ষেত্রের ন্যায় উক্ত পর্যায় সারণিটি অনেকের আবিষ্কার হইলেও, এক জনই উহার আবিষ্কর্তা হিসাবে চিহ্নিত— দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিভ। সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মৌলদের ওই সারণি রচনা করেন। সেই উপলক্ষে এই উদ্ভাবনের দেড়শত বৎসর উদ্যাপিত হইয়াছে ২০১৯ সালে। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যখন মেন্ডেলিভ রুশ ভাষায় ‘ওসনোভি থিমি’ (‘রসায়নের নীতি’) প্রণয়ন করেন, তখন পরিচিত মৌলের সংখ্যা ছিল ৬৫। ওই ৬৫টি মৌলের পারমাণবিক ওজন হাতে লইয়া— এবং উহাদের মধ্যে ভৌত বা রাসায়নিক ধর্মের সাযুজ্য লক্ষ করিয়া— মেন্ডেলিভ সারণিটি তৈরি করেন। কেবল মৌলগুলির পারমাণবিক ওজন সম্বল করিয়া এই দুরূহ কার্য কী ভাবে সম্ভব হইল, তাহা ভাবিয়া বিস্মিত হইতে হয়। এক্ষণে পিরিয়ডিক টেবিল অনেক উন্নত হইয়াছে, কারণ আজিকার বিজ্ঞানীরা জানেন, মৌলের পরমাণুর ওজন নহে, মৌলটির পরমাণুতে কয়টি প্রোটন বা ইলেকট্রন কণা আছে, তাহা মৌলটির ভৌত বা রাসায়নিক ধর্ম নিরূপণ করে। সুতরাং, মৌলগুলিকে বিন্যাসাকারে মানাইতে গেলে সূত্র হিসাবে পরমাণুর মধ্যে প্রোটন বা ইলেকট্রনের সংখ্যা বিচার করিতে হয়। শতাধিক মৌলের যে পর্যায় সারণি এক্ষণে ল্যাবরেটরিসমূহে ঝুলানো থাকে, তাহা ওই সংখ্যা-নির্ভর।
মেন্ডেলিভ তাঁহার প্রণীত পর্যায় সারণি উদ্ভাবন করিয়াছিলেন কী প্রক্রিয়ায়? এই প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে চালু তত্ত্বটি হইল স্বপ্ন। কথিত আছে, মৌলগুলির মধ্যে শৃঙ্খলা আবিষ্কারের চেষ্টায় রত মেন্ডেলিভ পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত হইয়া একদা নিদ্রায় আচ্ছন্ন হন। এবং স্বপ্নে নাকি মৌলগুলির বিন্যাসের পথ আবিষ্কার করেন। এই ধারণা এত চালু যে, মেন্ডেলিভ’স ড্রিম নামে রচিত একটি বই বেস্টসেলার হইয়াছে। পিরিয়ডিক টেবিল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ অবশ্য এই ধারণা বিশ্বাস করেন না— ইহাকে একটি ‘মিথ’ বলিয়া গণ্য করেন। মেন্ডেলিভ সম্পর্কে দ্বিতীয় কাহিনি এই যে, এক প্রকার তাস খেলায় তাসের বিশেষ সজ্জা দেখিয়া মৌলগুলির মধ্যে বিন্যাস আবিষ্কার করেন। ইহাকেও আর একটি ‘মিথ’ বলিয়া গণ্য করেন বিশেষজ্ঞেরা। পক্ষান্তরে, এই বিশ্বাস এক্ষণে বিশেষজ্ঞ মহলে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত যে, মেন্ডেলিভ পিরিয়ডিক টেবিলের সূত্র পাইয়াছিলেন সংস্কৃত বর্ণমালার বিশেষ সজ্জা হইতে। মেন্ডেলিভের কালে সেন্ট পিটার্সবার্গ সংস্কৃত ভাষা চর্চার এক বড় কেন্দ্র ছিল। মেন্ডেলিভও সংস্কৃত জানিতেন। তাহার উপরে বিন্যাসকালে মৌলদিগকে সাজাইতে গিয়া তদবধি অনাবিষ্কৃত মৌলের নামের সহিত এক (একুশ বুঝাইতে যে রূপে একবিংশ শব্দটি গঠিত হয়), দ্বি, ত্রি প্রভৃতি উপসর্গ যে ভাবে মেন্ডেলিভ ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার সংস্কৃতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া পিরিয়ডিক টেবিল রচনা করিবার বিশ্বাস দৃঢ় হয়।
সেই পিরিয়ডিক টেবিল সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদটি আকর্ষক। উক্ত সারণিতে ৯৯তম মৌলটি (যাহার পরমাণুতে ৯৯টি প্রোটন বা ইলেকট্রন উপস্থিত) বিশদে জানিতে পারিয়াছেন গবেষকরা। ঘটনাচক্রে উক্ত মৌলটির নাম আইনস্টাইনিয়াম। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আবিষ্কর্তাকে সম্মান জানাইতে গিয়া মৌলটির ওই নাম রাখা হইয়াছিল। প্রকৃতিতে দুষ্প্রাপ্য ওই মৌল আবিষ্কৃত হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণকালে ধ্বংসাবশেষে ওই মৌলটি খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছিল। যে হেতু মৌলটি বেশি তেজস্ক্রিয়— এবং সেই কারণে ক্ষণভঙ্গুর— সেই হেতু ওই মৌল সম্পর্কে বিশদ তথ্য বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। তথ্য জানিতে গেলে মৌলটিকে স্থায়ী হইতে হয়, অন্য মৌল বা যৌগের সহিত বিক্রিয়া করিতে হয়। এই দুই কার্যেই সম্প্রতি সফল হইয়াছেন আমেরিকায় লরেন্স বার্কলি ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা। তাঁহারা আইনস্টাইনিয়াম মৌলটি তৈরি করিয়া অন্য যৌগের সহিত বিক্রিয়ায় উদ্যোগী হইয়াছেন। কী পরিমাণে আইনস্টাইনিয়াম ল্যাবরেটরিতে তৈরি করিয়াছিলেন বিজ্ঞানীরা? ১ মিলিগ্রামের ১ কোটি ভাগের ২৫ ভাগ! আইনস্টাইনিয়ামের অজানা ধর্ম জানিবার লক্ষ্যে উক্ত সাফল্য কম নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy