মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন তাঁর দলের মন্ত্রী অখিল গিরির কুমন্তব্যের জন্য। একই সঙ্গে দলের নেতারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আজ যাঁরা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বিষয়ে অবমাননাকর উক্তি নিয়ে তোলপাড় করছেন, তাঁদের নেতারাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সম্বন্ধে নির্দ্বিধায় কুমন্তব্য করেছেন, করেই চলেছেন। সব মিলিয়ে, রাজনীতির যে ছবিটি আরও এক বার প্রকট হয়ে উঠল, তা অতি ক্লেদাক্ত। প্রতি বারই রাজনীতি এমন নীচে নেমে যায় যে, মনে হয়, তার নীচে বুঝি নামা অসম্ভব— এবং, প্রতি বারই রাজনীতি তদুপরি আরও নীচে নামতে থাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন? যত দিন রাজনীতি আছে, রাজনৈতিক বিরোধিতার ইতিহাসও তো তত দিনেরই— তা হলে এখন এমন কী ঘটল যে, রাজনৈতিক বিরোধিতা করার জন্য বারে বারেই কদর্যতার অতল থেকে মণিমুক্তো তুলে আনতে হচ্ছে? এই প্রশ্নের অন্তত আংশিক উত্তর রয়েছে নেতৃত্বের কাছে। দলের শীর্ষনেতারা যদি কোনও লক্ষ্মণরেখার পরোয়া না করেন, যদি কোনও কথাই তাঁদের বিবেচনায় মুখে আনার অযোগ্য না হয়, তবে অন্যান্য নেতার কাছে খুব স্পষ্ট একটি বার্তা পৌঁছয়— যত ক্ষণ রাজনীতির গোলায় উপচে পড়ে লাভ, তত ক্ষণ যে কোনও কথা উচ্চারণ করা যায়। বিরোধী দলের নেতাকে রাজনৈতিক আক্রমণের বদলে তাঁকে মশকরার পাত্র বানিয়ে ফেলার মধ্যে যে বিপজ্জনক অ-রাজনীতির বীজটি বপন করা হয়েছিল, দশ বছরে সেই বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা ফলের ভারে আনত।
ভারতীয় রাজনীতির বয়ানে এখন যে ব্যক্তি-আক্রমণের ভাষ্যটি ক্রমে মূলস্রোতে পরিণত হয়েছে, তার ভিতরে থাকা বিদ্বেষগুলির কোনওটিই হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি, তা ভারতীয় সমাজের বহু শতকের জমে থাকা ক্লেদ। সেই বিদ্বেষের একটি প্রধান অক্ষ লিঙ্গ। ভারতীয় সমাজে যেমন মহিলারা তাঁদের লিঙ্গপরিচয়ের কারণেই শারীরিক ও ভাষাগত আক্রমণের লক্ষ্য— তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা আরও বেশি— ভারতীয় রাজনীতিতেও তার অবিকল প্রতিফলন ঘটে। কোনও পুরুষকে হাতে চুড়ি পরার পরামর্শ দেওয়া, অথবা কারও যৌন পছন্দ নিয়ে কটূক্তি করা এই আক্রমণেরই আর এক দিক। জাতি আরও একটি অক্ষ। মণ্ডল কমিশন-উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে জাতির প্রশ্নে সরাসরি আক্রমণ করা কঠিন হয়েছে, কিন্তু সেই বিদ্বেষকে দূর করে, সাধ্য কার! ফলে, অতি ক্ষীণ রাখঢাকসমেত জাতিভিত্তিক আক্রমণও চলে। শ্রেণির প্রশ্নটিতে সেই রাখঢাকেরও প্রয়োজন হয় না। আর রয়েছে গাত্রবর্ণের প্রসঙ্গ। এই সূর্যকরলাঞ্ছিত ভারতভূমিতে কৃষ্ণবর্ণের প্রতি সামাজিক ঘৃণা রাজনীতির সর্বাঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকে। যেমন থাকে সমাজের গায়েও।
রাজনীতির কদর্যতা যে প্রতিনিয়ত সমাজের প্রতিফলন ঘটাতে ঘটাতে চলে, সেই প্রক্রিয়াটি নিতান্ত একমুখী নয়। রাজনীতি যে-হেতু সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভ্যস্ত, চর্চিত বিদ্বেষের ভাষ্যেই কথা বলে, তাই সম্ভবত সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরও এই কদর্যতাকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে হয় না। বরং, এতেই অভ্যাসের আরামটুকু পাওয়া যায়। শালীনতা, শীলনের চর্চাই বরং অপরিচিত। সেই কারণেই, বহু দশকের চেষ্টায় রাজনীতির পরিসরে যদি বা কোনও পরিশীলনের সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল, তার ভেঙে পড়তে সময় লাগল না বিলকুল— নেতার সামান্য আশকারাতেই রাজনীতি নেমে গেল কদর্যতার অতলে। তা হলে কি দোষ মূলত সমাজেরই? সে কথা বললে সহজে দায় ঝেড়ে ফেলা যায়, কিন্তু তাতে সত্যের প্রতি নিষ্ঠা বজায় থাকে না। সত্যটি হল, সমাজকে পথ দেখানোই রাজনীতির কাজ, সমাজের অন্ধকারগুলিকে বিনা প্রশ্নে অনুসরণ করা নয়, সেগুলিকে মূলধন করে রাজনৈতিক লাভ অর্জন করা নয়। এই প্রাথমিক দায়িত্ব পালনেও ভারতীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy