যখন ইংল্যান্ডে এক জন বণিক বছরে ২০০ পাউন্ড আয় করতেন, সে কালে ক্রিকেট খেলে ১০ লক্ষ পাউন্ড রোজগার করতেন ডব্লিউ জি গ্রেস। শুধু এটুকু খবরেই বোঝা যায়, কেন ‘প্রথম সুপারস্টার ক্রিকেটার’-এর অভিধাটি তিনি পেয়ে থাকেন। তবু, যে কোনও মহাতারকাকে ঘিরেই যা হয়— প্রয়াণের শতবর্ষ পার করে ক্রমশ তাঁকে ঘিরে মিথ বা পৌরাণিক গালগল্পের ভিড় জমেছে। আশার কথা, অবশেষে ক্রিকেটের স্বার্থে জনশ্রুতির মেঘ সরাতে তৎপর হয়েছে ক্রিকেট বই উইজ়ডেন। ইতিহাস ঘেঁটে তাঁর রান, শতরান, উইকেট সংখ্যা প্রভৃতির যথার্থ পরিসংখ্যান তৈরি হয়েছে। কাজটি জরুরি— কোনও ব্যক্তি যতই প্রতিভাধর হন না কেন, তথ্যপ্রমাণে অতিরঞ্জন অপরাধ। তাতে সত্যের অপলাপ হয়, ইতিহাসের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা হয়। মনে রাখা দরকার, রেকর্ড বই রোম্যান্টিকতার জায়গা নয়, তার সত্যবচন কারও প্রতিভাকে খাটো করে না, বরং ইতিহাসে তার যথাযথ স্থানটি তৈরি করে দেয়। ক্রিকেটের লোকপ্রিয়তা নির্মাণে পথিকৃৎসম গ্রেসকে তখনই সম্মান জানানো হবে, যখন তাঁর কৃতিত্বগুলি প্রকৃত আকারে তুলে ধরা হবে, মনের মাধুরী মিশিয়ে নয়। প্রসঙ্গত, ইতিহাসবিদ সি এল আর জেমস-এর মন্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য। আর্থিক ভাবে গ্রেস ছিলেন শক্তিশালী, শারীরিক ও মানসিক ভাবেও সম্পূর্ণ সুস্থ, তবুও সব মানুষের মতোই সমস্যা যে তাঁরও ছিল না এমন নয়, কিন্তু তিনি তা বাদ দিয়ে চলতে জানতেন। অর্থাৎ তাঁর যা ছিল না, সে জিনিসে তাঁর প্রয়োজনও ছিল না— গ্রেস সম্পর্কে এমনই বলেন জেমস। এমন এক জন মানুষকে কল্পনার আবরণে ঢেকে রাখা আসলে অতীতের খণ্ডিত ছবি তুলে ধরা, ভবিষ্যতের কাছে অর্ধসত্য উপস্থাপন।
মিথ এবং ইতিহাসের বিরোধ যদিও এখানেই। মানুষ প্রতীকের পূজারি— মিথ প্রকৃত মানুষকে ঢেকে দেয়, জনরুচির পছন্দমতো এক ব্যক্তির নির্মাণ করে। এবং, তাকে এমন এক পাদপীঠে তুলে দেয়, যা সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে, রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে যার নাগাল পাওয়া অসম্ভব। ইদানীং, ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সভ্য-সমর্থকরা যেমন প্রধানমন্ত্রীর গুণকীর্তন করতে গিয়ে এমনই অমানুষিক সব কৃতিত্ববর্ণনে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন, যা নরেন্দ্র মোদী কেন, কোনও মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব নয়। কেবল বিজেপি নয়, যুগে-যুগে দেশে-দেশে রাজনৈতিক নেতাদের এমনই অতিকায় মূর্তি জনমানসে বুনে দিতে নিরবচ্ছিন্ন প্রচারাভিযান চলতে থাকে। ইতিহাস বস্তুটি ঠিক তার বিপরীত— তা নির্মম ভাবে অতিরঞ্জন বাদ দিয়ে সত্যটুকুকে টেনে বার করে আনে। যা ঘটেছে তা যথার্থ ভাবে উপস্থাপন করাই ইতিহাসের কাজ। সুতরাং, একমাত্র ইতিহাসই মিথের আবরণ সরিয়ে অতীতকে তাঁর প্রকৃত মাপে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বটি নিতে পারে। ডব্লিউ জি গ্রেসের ক্ষেত্রে সেই জরুরি কর্তব্য পালন করার জন্য উইজ়ডেন ধন্যবাদার্হ। গ্রেস যে ফাঁপিয়ে-তোলা রেকর্ডের অধিকারী অতিমানব নন, বরং সর্বকালের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটপ্রতিভা (যেমন এ বিশ্বে আরও অনেকেই আছেন), এবং ক্রিকেটকে একা হাতে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই কথাগুলি সামনের সারিতে উঠে আসবে। তাতে প্রচারযন্ত্রের অবাঞ্ছিত বাড়বাড়ন্তও রুখে দেওয়া যাবে— সামগ্রিক ভাবে সেই লাভ ইতিহাসের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy