সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে ঢাল হইয়া উপকূলকে রক্ষা করে রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ অরণ্য— কথাগুলি এযাবৎ কাল যেন পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাস্তবে ম্যানগ্রোভের উপযোগিতা কতখানি, বহু দিন পর্যন্ত তাহা যথাযথ উপলব্ধি করিতে পারে নাই রাজ্য সরকার হইতে সাধারণ মানুষ। ফলে, উন্নয়নের প্রবল ধাক্কায় ধরাশায়ী হইয়াছে বিস্তীর্ণ বাদাবন। গত ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো জানাইয়াছে, ১৯৮০ হইতে ২০০৫ সালের মধ্যে উপকূলে উন্নয়ন করিতে গিয়া বহু দেশ ৪০ শতাংশ ম্যানগ্রোভ নষ্ট করিয়াছে। সুন্দরবন অঞ্চলে মাছের ভেড়ি এবং বেআইনি নির্মাণের জন্য ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের অভিযোগ বহু পুরাতন। ইহার পরিণতি বোঝা গিয়াছিল আয়লার পর। কিন্তু জ্ঞানচক্ষু তখনও সম্পূর্ণ উন্মীলিত হয় নাই। হইল, পর পর দুই বৎসর আমপান এবং ইয়াসের তাণ্ডবে। ফল, বিশেষজ্ঞরা এত দিন যাহা পারেন নাই, তাহা এখন সম্ভব হইয়াছে। সরকারি সূত্রে জানা গিয়াছে, সুন্দরবন জুড়িয়া আগামী ১৫ দিনে ১০ লক্ষ গাছ লাগানো হইবে। সরকারের সঙ্গেই বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও ম্যানগ্রোভ রোপণে হাত লাগাইয়াছে।
আমপান-পরবর্তী সময়েও সরকারি উদ্যোগে ৫ কোটির অধিক ম্যানগ্রোভ চারা বসানো হইয়াছিল— অন্তত, তেমন একটি হিসাব মিলিয়াছিল। আমপানের পর গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বিপর্যয় হইতে প্রতিরক্ষার প্রথম স্তর হিসাবে ম্যানগ্রোভ রোপণের পরামর্শ দেয়। কারণ, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উদ্ভূত জলোচ্ছ্বাসকে এই গাছ প্রতিহত করে, উপকূল রক্ষা পায়। তাহাদের শিকড় মাটির অনেক গভীরে গিয়া মাটিকে শক্ত করিয়া ধরিয়া রাখে। কিন্তু সেই চারা বড় হইয়া উপকূল রক্ষার কাজ করিতে অন্তত ৪-৫ বৎসর সময় লাগে। এই বৎসরের ইয়াস সেই সময়টুকু দেয় নাই। গত বৎসরে রোপণ করা চারার অনেকগুলিই এই ঝড়ে নষ্ট হইয়াছে। এবং ইয়াসে দেখা গিয়াছে, যে সমস্ত নদীবাঁধে ম্যানগ্রোভ ছিল, সেইখানে ক্ষতির পরিমাণ কম। ম্যানগ্রোভহীন অঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। এই হিসাবকে মাথায় রাখিয়াই ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সুন্দরবন জুড়িয়া কয়েক কোটি ম্যানগ্রোভ রোপণের সরকারি পরিকল্পনা করা হইয়াছে। তৈরি হইতেছে নার্সারিও।
কিন্তু শুধুমাত্র ম্যানগ্রোভ রোপণ করিলেই সুন্দরবন বাঁচিবে না। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ এবং তাহার রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি যে এত দিনেও বিশেষ গতি পায় নাই, এই বৎসরের ঝড়ে তাহা প্রমাণিত। এবং ভাবিতে হইবে পুনর্বাসন প্রকল্পটি লইয়াও। উষ্ণায়নের কারণে বিধ্বংসী ঝড়ের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাইবে। আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবনের অনেক দ্বীপ তলাইয়া যাইতে পারে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ‘ভিশন ২০২০’-তেও বলা হইয়াছিল আগামী ৩০ বৎসরের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সুন্দরবন খালি করিয়া দিবার। তাহা আদৌ সম্ভব কি না, এই বিপুল সংখ্যক মানুষের পুনর্বাসনের প্রশ্নটিকে রাষ্ট্র এবং সমাজ কী ভাবে দেখিবে, সে বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন। তৎপূর্বে প্রয়োজন স্থায়ী ত্রাণশিবির গঠন। ইয়াসে দেখা গিয়াছিল, কিছু ত্রাণশিবির অবস্থানগত কারণে কাজের উপযুক্ত নহে। পরবর্তী ঝড়ের পূর্বেই এই অসুবিধাগুলি দূর করা প্রয়োজন। সুন্দরবনের যথেষ্ট ক্ষতি ইতিমধ্যেই হইয়াছে। তাহা আরও বৃহত্তর রূপ যাহাতে ধারণ না করে, তাহার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, এখনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy