কেবল নাগরিকই নন, সরকারের কাছে তথ্য চেয়ে নিরাশ হতে হচ্ছে সংসদ, আদালতকেও। কুম্ভমেলা শেষ হয়ে গেল, জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মেনে গঙ্গা ও যমুনার জলের মান নিয়ে রিপোর্ট জমা দিল না উত্তরপ্রদেশ সরকার। কুম্ভমেলাতে কত জনের মৃত্যু হয়েছে, সেই তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই, সংসদে জানাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তবে কি কুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে ত্রিশ জন মারা যাননি? না কি, সেই মৃত্যুগুলি সরকার বাহাদুর নজর করার যোগ্য বলে মনে করেনি? এ ভাবেই সরকার এক দিন সংসদে জানিয়েছিল, কোভিড লকডাউনে বাড়ি ফিরতে গিয়ে কত পরিযায়ী শ্রমিক নিহত হয়েছেন, সরকার জানে না। বিরোধী সাংসদদের প্রশ্নের উত্তর দিতে সরকারের দায়বদ্ধতা গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার এক প্রধান ভিত্তি। তাকে হেলায় নস্যাৎ করা চলে না। সমাজমাধ্যম থেকে গত তিন বছরে মোট কতগুলি পোস্ট ‘ডিলিট’ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে, জানতে চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক যা জানিয়েছে, তাকে ‘উত্তর’ বলা চলে না। লিখিত উত্তরে মন্ত্রী জিতিন প্রসাদ বলেছেন, সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব, শালীনতা এবং নীতিবোধ রক্ষা, আদালতের অবমাননা ঠেকানো, বন্ধুত্বপূর্ণ পড়শি দেশের সম্মান রক্ষা এবং এমন কিছু তথ্য যা দেশের স্বার্থে প্রকাশ করায় বিধিনিষেধ রয়েছে, এমন সমাজমাধ্যমের পোস্টকেই সরানোর জন্য নোটিস দেওয়া হয় আইটি রুল মেনে। অর্থাৎ, কী নিয়ম মেনে সমাজমাধ্যমে নাগরিকের মন্তব্য মুছে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সরকার, সেটাই জানিয়েছেন। যা জানতে চাওয়া হয়েছিল— গত তিন বছরে কতগুলি পোস্ট মুছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র, সে তথ্য দেওয়া হয়নি। অথচ প্রশ্নটি নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার সুরক্ষার নিরিখে যথেষ্ট অর্থপূর্ণ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারও অবশ্য তথ্য গোপনের দায় থেকে মুক্ত নয়। ডেঙ্গি তীব্র হলে আক্রান্ত ও মৃতের তথ্য রাজ্য পাঠাতে চায় না কেন্দ্রকে। গণতন্ত্রে সরকারের একটি মৌলিক কর্তব্য হল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে প্রশাসনে স্বচ্ছতা রাখা। তথ্যের অধিকার আইন (২০০৫) পাশ হওয়ার পর তথ্য প্রদানের দায়বদ্ধতা আরও স্পষ্ট ভাবে আরোপিত হয়েছে রাষ্ট্রের উপরে। আইনটির মাধ্যমে নানা সরকারের বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি প্রকাশিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, বা সেই কারণেই, সদস্য নিয়োগ না করে তথ্য কমিশনগুলিকে অকেজো করে রাখা হচ্ছে। ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনে এগারোটি পদের আটটিই শূন্য ছিল, রাজ্যগুলির অবস্থাও ছিল তথৈবচ। তথ্য কমিশনের কাছে আবেদনের পাহাড় জমছে সব রাজ্যে। সেই সঙ্গে আইন সংশোধন করে তথ্য দেওয়ার দায়কে ক্রমশ শিথিল করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে তথ্যের অধিকার আইন সংশোধন করায় এখন তথ্য কমিশনারদের কাজের মেয়াদ, বেতন, সুযোগ-সুবিধা চলে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাতে কমিশনারদের স্বাতন্ত্র্য কমবার আশঙ্কা থাকে। ব্যক্তিগত ডিজিটাল তথ্য সুরক্ষা আইনের (২০২৩) জন্য বহু তথ্য চলে গিয়েছে তথ্যের অধিকার আইনের আওতার বাইরে।
সংসদে, বিধানসভায়, আদালতেও যদি সরকারি তথ্য তলব করে পাওয়া না যায়, তা হলে দেশের কাছে এই বার্তাই যায় যে, তথ্যের অধিকার একটি ধারণামাত্র। বাস্তবে তথ্য দেওয়া স্রেফ সরকারের মর্জি। সেই ধারণা আরও পোক্ত হয়, যখন কেন্দ্র বা রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর বাজেট-বক্তৃতায় হিসাব দাখিলের কৌশলে নানা বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়, জাতীয় স্তরের সমীক্ষাঅনিয়মিত হয়, তার ফলাফল প্রকাশে বাধা দেওয়া হয়। এর পরেও রয়েছে হিংসা। একটি অসরকারি হিসাব অনুসারে, অন্তত পঞ্চাশ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন তথ্য চাইবার ‘স্পর্ধা’ দেখানোর জন্য। তথ্য দেওয়া এতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে একটি গণতন্ত্রের জনপ্রতিনিধিদের কাছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)