মার্সেলাস ছিলেন এলসিনর দুর্গের প্রহরী। কিন্তু শেক্সপিয়র তাঁর হ্যামলেট নাটকে এই ‘সামান্য’ দুর্গরক্ষীর উক্তিতে এমন একটি বাক্য লিখেছিলেন, যা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। মার্সেলাস বলেছিলেন: সামথিং ইজ় রট্ন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী সাহিত্যের ছাত্র, তদুপরি নাট্যকার। অতএব প্রশ্ন জাগতেই পারে, পঁচিশে বৈশাখ তিনি যখন বাংলা আকাদেমির আলোকিত সভামঞ্চে বিচিত্রনামা আনকোরা পুরস্কারটির প্রথম প্রাপক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা করছিলেন, তখন কি তাঁর মার্সেলাসের উক্তিটি মনে পড়েনি? মনে মনে গ্লানি বোধ করেননি তিনি? অবশ্যই এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে না, নাট্যকার-মন্ত্রী তাঁর প্রকৃত অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে পারবেন না, নেত্রী-বিদূষণে ব্যথিত এবং সমালোচকদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ আওড়ে বলবেন, ‘রেখেছ বাঙালী ক’রে মানুষ কর নি।’ দক্ষ অভিনেতার পক্ষে এমন ব্যথা ও ক্ষোভের প্রকাশ অতি সহজ কাজ। অথবা, হয়তো এটাই মনের কথা, ক্ষমতার চোরাবালিতে সমস্ত গ্লানিবোধ হয়তো ব্রহ্মতালু অবধি নিমজ্জিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে এই রাজ্য এবং তার নাগরিক সমাজের গ্লানি যে অতলে পৌঁছল, তার দায় এবং ভার বাস্তবিকই দুর্বহ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কী প্রজাতির ‘কবিতা’ লেখেন, ট্রেডমিলে পদচারণার ছন্দে তাঁর নিরলস সাহিত্য সাধনার ‘প্যাশন’ কেমন অনর্গল বিচ্ছুরিত হয়, সে-সব নিয়ে গত কয়েক দিনে জনারণ্যে বিস্তর চর্চা হয়েছে, ব্যঙ্গপ্রাণ তামাশাপ্রিয় বাঙালির সমাজে এবং সমাজমাধ্যমে সাড়ে বত্রিশ রকমের কৌতুকের বান ডেকেছে। কিন্তু, কৌতুক নয়, ব্যঙ্গ নয়, তামাশা নয়, ‘কাব্য’-বিচারের বিলাসিতাও নয়, এ বড় গভীর উদ্বেগের কাল। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক বাঙালি অনেক দিন ধরেই তার মানসিক সম্পদগুলিকে হারিয়ে ফেলছে, হারিয়ে ফেলছে তার গৌরববোধ, তার উৎকর্ষের সাধনা, তার স্বাভাবিক সুরুচি। কিন্তু যে সুস্থ বুদ্ধি এবং কাণ্ডজ্ঞানকে সভ্যতার প্রাথমিক শর্ত বলে জানা ছিল, সেটাও কি একেবারে শেষ হয়ে গেল? সংস্কৃতির নামে যথেচ্ছাচারই বাংলার নতুন ব্রতকথা হিসাবে স্বীকৃত হল?
যথেচ্ছাচারের মূলে অবশ্যই ক্ষমতার অপব্যবহার, পশ্চিমবঙ্গে যা আজ এক বিকট চেহারা নিয়েছে। এ কোনও আকস্মিক সমাপতন নয় যে, বাংলা আকাদেমির ইতিহাসে এই প্রথম মন্ত্রী নিজেই চেয়ারপার্সন হলেন এবং তাঁর জমানাতে প্রবর্তিত নতুন পুরস্কার পেলেন মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধিরূপে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে পুরস্কারের স্মারক ইত্যাদি সামগ্রী গ্রহণ করলেন সেই চেয়ারপার্সন, এবং মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চ আলো করে বসে থাকলেন তাঁর মহাসনে। নিশ্চিন্দিপুরের প্রসন্ন গুরুমহাশয়ও নির্বাক হয়ে যেতেন, কারণ এমন দৃশ্য নাট্যশালাতেও সুলভ নয়। কিন্তু উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ হল, রাষ্ট্রক্ষমতার এই উৎকট অনাচারে সায় দিচ্ছেন, এমনকি তার শরিক হচ্ছেন এমন অনেকেই, যাঁরা সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির ভুবনে কৃতবিদ্য, সৃষ্টিশীল, প্রতিভাবান মানুষ। ‘শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক’দের মত নিয়েই মুখ্যমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেওয়া হল— কৈফিয়তের বয়ানটি যত নির্বোধই হোক, এ-কথা তো অস্বীকার করার নয় যে বাংলা আকাদেমি তথা পুরস্কার কমিটির সিংহাসনগুলি আলো করে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা— সকলেই না হোক— অনেকেই স্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত, যে প্রতিষ্ঠা তাঁরা আপন সামর্থ্যেই অর্জন করেছেন। অথচ এই ‘সুধী’বৃন্দই অম্লানবদনে ক্ষমতার বন্দনায় বিগলিতবদনে নতজানু হচ্ছেন, একটি নির্লজ্জ অনৈতিকতার সাফাই গাইতে ঝুড়ি ঝুড়ি ছেঁদো কথার মালা গাঁথছেন! এমন লজ্জাহীন স্তাবকতার প্রদর্শনী দেখে দুর্গরক্ষী মার্সেলাস নিশ্চয়ই বলছেন: কিছু একটা পচে গেছে এই রাজ্যটিতে, যার নাম পশ্চিমবঙ্গ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy