মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
একটা কেষ্টকে ধরলে লক্ষ কেষ্ট আছে।— জানিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গের যে হাল, তাতে শঙ্কা জাগতেই পারে, এই উক্তিতে কি তবে একটি গূঢ় সত্যই মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রীর মুখ ফস্কে বেরিয়ে পড়ল? যাকে বলে ‘ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ’? তিনি কি এতদ্দ্বারা ফাঁস করে দিলেন যে, তাঁর কেষ্ট, তথা বীরভূমের দলনেতা অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে যে-সব দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যের আকাশ-বাতাস অধুনা ম-ম করছে, তেমন দুর্নীতির বীজ, চারাগাছ, মহীরুহ এবং আগাছায় পশ্চিমবঙ্গ এবং তার শাসক দল পরিপূর্ণ হয়ে আছে? এই সংশয়ের একটি নির্দিষ্ট কারণও আছে। দুর্জনে বলছে, অনুব্রত মণ্ডল এবং তাঁর ধরা-পড়ে-যাওয়া সতীর্থেরা দলের প্রয়োজন মেটাতেন। কোন প্রয়োজন? বাহুবলের প্রয়োজন, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রয়োজন এবং অর্থের প্রয়োজন। তাঁরা ধরা পড়লে দলের ‘সাপ্লাই লাইন’ ব্যাহত হবে, এই দুশ্চিন্তার মেঘ কাটিয়ে দলীয় নেতা ও কর্মীদের মনে সাহস সঞ্চার করতেই কি তবে এমন এক দৈববাণী ধ্বনিত হতে হল: একটা কেষ্টকে ধরলে লক্ষ কেষ্ট আছে?
দুর্জনের কথা থাকুক। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই বলবেন, তাঁর কথার সহজ সরল অর্থ এই যে, এক জন দু’জনকে আটক বা হয়রান করে কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থা তথা তাদের পশ্চাদ্বর্তী পুতুলনাচের কারিগরেরা তাঁর বা তাঁর দলের কোনও ক্ষতি করতে পারবেন না, কারণ তাঁর অসংখ্য সমর্থক ও অনুরাগী তাঁর পাশে আছেন, তাঁরাই দলের সম্পদ এবং তার শক্তি, প্রয়োজনে তাঁরাই রাস্তায় নামবেন, কেন্দ্রীয় শাসকদের এই ‘অভিসন্ধিমূলক’ আক্রমণকে রাস্তার লড়াইয়ে প্রতিহত করবেন। এই অর্থে বিচার করলে, তিনি নতুন কিছু বলেননি। তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনে যখনই কোনও সঙ্কট এসেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার মোকাবিলায় রাস্তায় নেমেছেন, রাস্তা কখনও মিছিলের সরণি হয়েছে, কখনও অবস্থানের ঠিকানা, কখনও বা অনশনের মঞ্চ। ভারতীয় রাজনীতিতে এই পদ্ধতিটি মোটেও বিরল নয়, ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা সমস্যায় পড়লেই ‘জনতার আদালত’-এ গিয়ে থাকেন। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে এই পদ্ধতিকেই তাঁর ‘জনবাদী রাজনীতি’র মুখ্য প্রকরণ করে তুলেছেন, তার তুলনা এ দেশেও খুব বেশি মিলবে না। সুতরাং, ‘লক্ষ কেষ্ট’ প্রদর্শন কেবল তাঁর হুমকি নয়, তাঁর রাজনীতিও বটে।
এই ‘রাজনীতি’ কি ন্যায়সম্মত? তদন্তের কাজে সমস্ত রকমের সহযোগিতা করাই কি রাজ্য সরকার ও তার নেতৃত্বের প্রথম কাজ নয়? তার বদলে প্রকারান্তরে অভিযুক্তদের পক্ষ অবলম্বন করে কি মুখ্যমন্ত্রী শাসনতন্ত্রের মৌলিক ক্ষতি সাধন করছেন না? প্রশ্নগুলি অনিবার্য। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রশাসনিক নৈতিকতা বা শিষ্টাচারের প্রশ্ন তুলে বোধ করি লাভ নেই। সংশয়ের অবকাশ নেই যে, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলিও আজ সেই নৈতিকতার ধার ধারে না। দৃশ্যত সঙ্কীর্ণ রাজনীতির লক্ষ্য পূরণেই ইডি-সিবিআইদের ব্যবহার করা হয়, যে কারণে এই সংস্থাগুলি কেবল বিরোধী দল শাসিত রাজ্যেই তৎপর হয়, অন্যত্র শত দুর্নীতিতেও শান্তিকল্যাণ। কিন্তু অন্য একটি প্রশ্ন সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকেও উত্তরোত্তর ভাবিয়ে তুলছে। তাঁর রাজ্যে সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অনাচারের যে লক্ষণগুলি ক্রমাগত উন্মোচিত হয়ে চলেছে, সেগুলি কি শাসক হিসাবে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় রকমের আঘাত করছে না? লক্ষ লক্ষ কেষ্ট যদি রক্তবীজের মতো ছড়িয়ে পড়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত রাজ্যবাসী কি তার প্রতিকার করতে চাইবেন না? জনতার আদালতে অনন্তকাল নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের মৌলিক শর্তগুলিকে কি অগ্রাহ্য করেই চলবে? না কি চিন্তাবিহীন ভক্তিরসেই নিমজ্জিত হয়ে থাকবে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ? প্রশ্নগুলো থেকেই গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy