পৃথিবী সূর্যের চার দিকে ঘোরে, রোমের শাসকরা যখন এই কথাটি প্রত্যাহার করে উল্টো কথা বলতে বাধ্য করলেন গালিলেও গালিলেইকে, শোনা যায়, মহান বিজ্ঞানী তখন নাকি নিজের মনে বলেছিলেন, ‘এপ্পুর সি মুয়োভে’— ‘তবু তা-ই ঘোরে’। ছ’শো বছর আগের কথা, কিন্তু সত্যিকারের চিন্তক দার্শনিক শিল্পী বিজ্ঞানী কবেই বা সত্যকথন থেকে বিরত থেকেছেন— নিজের সমূহ ক্ষতি, এমনকি প্রাণসংশয়ের মুখেও! দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি নিয়ে গোয়ায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরি-প্রধান, ইজ়রায়েলের নাদাভ লাপিদের মন্তব্যে হইচই পড়ে গেল— প্রশ্ন উঠল, কেন তিনি এ ছবিকে বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, প্রচারমূলক, ওই বিভাগের বাকি ছবিগুলির পাশে নিতান্ত বেমানান তথা এই চলচ্চিত্র উৎসবে অন্তর্ভুক্তির অনুপযুক্ত বললেন। নাদাভ ফিরে গিয়েছেন, তবু জল গড়িয়ে চলেছে; অন্যতম জুরি তড়িঘড়ি বলেছেন এ মন্তব্য নাদাভের ‘ব্যক্তিগত মত’, ছবির পরিচালক ফুঁসে উঠেছেন নাদাভ প্রমাণ করুন এ ছবিতে দেখানো ঘটনার কিছুমাত্র অসত্য, এমনকি ভারতে ইজ়রায়েলের রাষ্ট্রদূতও বলেছেন নাদাভের মন্তব্য ভারতের অসম্মান। বিজেপি নেতাদের প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়।
তবু— ‘এপ্পুর সি মুয়োভে’, পৃথিবীই সূর্যের চার দিকে ঘোরে, এবং দ্য কাশ্মীর ফাইলস সম্পর্কে জুরি-প্রধানের মন্তব্যের সারবত্তাও পাল্টে যায় না। কারণ এ মন্তব্য শুধুই ছবিটি নিয়ে, তার খামতি ও অসঙ্গতি নিয়ে, দর্শককে এ ছবির সুকৌশলে এক বিশেষ সিদ্ধান্তের দিকে চালনা করা নিয়ে— ছবিতে বলা ইতিহাস, তথ্য বা সত্যের অপলাপ নিয়ে নয়। নাদাভ ফিরে গিয়ে তাঁর মন্তব্যের ‘ভুল ব্যাখ্যা’ নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন, যে ব্যাখ্যা তিনি নিজেকরেননি, যে ব্যাখ্যায় তাঁর কোনও হাত নেই। ছবির মুক্তি ইস্তক বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা কেমন ভাবে এ ছবিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ‘ব্যবহার’ করেছেন, কেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ছবির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তাঁর জানার কথা নয়। ভারতের বর্তমান শাসনতন্ত্র ও সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে তার প্রতাপের কথা তাঁকে কেউ বলে দেয়নি, নয়তো তিনি জানতেন এই ভারত সত্য ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ নয়, বরং তাকে নিজের পছন্দমতো ঘুরিয়ে বা পাল্টে নেওয়া তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মোগলের কাছে রাজপুত রাজার হার সে মানতে পারে না, মুসলমানের সঙ্গে হিন্দু রানির রোম্যান্স তার কাছে অসহ্য। একই কারণে নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের চরম দুরবস্থা তার কাছে স্রেফ ধর্মের, ‘হিন্দু’র নিগ্রহ। এই ছবি নিয়ে বিজেপির এত উৎসাহ যে কারণে, যে জন্য বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ছবিটি সরকারি খরচে জনতাকে দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছে, ঠিক সেই কারণেই চিত্র-সমালোচক থেকে ইতিহাসবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষকদের মতে ছবিটি গভীর ভাবে সমস্যাজনক।
তবু বোধসম্পন্ন ভারতীয় নাগরিকের প্রকৃত সমস্যা ছবিটি নয়। ছবি নিয়ে এই উৎসাহ এবং ছবির সমালোচনা নিয়ে এই ক্রোধই হল মূল বিপদের উৎস। বর্তমান জমানায় ভারতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, কিংবা কোভিড-ব্যবস্থাপনা— যে কোনও বিষয়ে অব্যবস্থা বা অবনমনের কথা কেউ বললে, সরকার উদ্যত হয়েছে তাঁকে ছোট করতে, অস্বীকার বা আক্রমণ করতে। গত কয়েক বছরে কত লেখক বা সাংবাদিকের শাস্তি হয়েছে, কত জনকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা ইতিমধ্যে সুদীর্ঘ। কিছু ক্ষেত্রে দেশদ্রোহের শাস্তি নেমে এসেছে কেবল সমালোচনার অপরাধে। নাদাভ বিদেশি নাগরিক, তাই তাঁর ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রত্যাঘাতে শামিল হল কূটনীতিও। এই যে ভয়ানক সরকারি চাপ মানুষের মতামত ও মতপ্রকাশের অধিকারের উপর চেপে বসেছে, পঁচাত্তর বছরের দেশে এই হল গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার নিম্নতম বিন্দু: সন্দেহ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy