গরুর লরি চলতে থাকে সীমান্তের দিকে।
গরু পাচার নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত চলছে পশ্চিমবঙ্গে। এই অনুসন্ধান জরুরি— পাচারের মতো অপরাধ নিবৃত্ত করাই সরকারের কর্তব্য। প্রশ্ন একটাই— কেন্দ্রীয় সংস্থা এখনও অবধি এমন কী জানিয়েছে, যা আগেই জানতেন না এই রাজ্যের জনপ্রতিনিধি বা সরকারি আধিকারিকরা? পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম বহু আগেই যা তুলে ধরেনি রাজ্যবাসীর কাছে? ধরা যাক ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত রঘুনাথগঞ্জের একটি সংবাদ প্রতিবেদন। তাতে বলা হয় যে, জঙ্গিপুর শহর তৃণমূলের সহ-সভাপতি সুদীপ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভাগীরথী সেতুর পূর্ব প্রান্তে গরু বোঝাই সীমান্তগামী আটটি লরি আটক করেন তৃণমূল কর্মীরা। দলের পতাকা, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি-সহ ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই কী এক কারণে তাঁরা নীরবে সরে যান, আবার গরুর লরি চলতে থাকে সীমান্তের দিকে। জঙ্গিপুরের পথ দিয়ে নিয়মিত গরু পাচার নিয়ে স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন, সে কথাও উল্লিখিত হয়েছে ওই রিপোর্টে। একই কথা প্রযোজ্য কয়লা পাচারের ক্ষেত্রেও। গত আট-দশ বছরে অগণিত সংবাদ আলেখ্য তুলে ধরেছে গরু, কয়লা, সোনা, মাদক প্রভৃতি পাচারের ‘করিডর,’ পাচার-পদ্ধতির খুঁটিনাটি, পাচারচক্র চালু রাখার পিছনে পুলিশ, বিএসএফ, জেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা। কখনও জেলায়, কখনও সীমান্তে অগণিত পাচারকারী গ্রেফতার হয়েছে, মামলা হয়েছে, সে সব থেকেও প্রচুর তথ্য মিলেছে। সহজ কথায়, যে তথ্য সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল, তা প্রশাসনের কাছে ছিল না, এ অবিশ্বাস্য। স্পষ্টতই, পাচার নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’তরফেরই হাতে ছিল।
তবু তৃণমূল নেতারা পাচারের অভিযোগকে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির রাজনৈতিক অভিসন্ধি বলে দাবি করছেন। এই দাবি একই সঙ্গে মিথ্যা ও সত্য। মিথ্যা, কারণ এই বিস্তৃত, সুসংগঠিত পাচারচক্র রাজ্যের শাসক দলের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া চলা সম্ভব, এ কথা অকল্পনীয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দুর্নীতির দায় রাজ্য সরকারকে গ্রহণ করতেই হবে। আবার তা কিয়দংশে সত্যও বটে, কারণ পাচার প্রতিরোধ নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের উদ্দেশ্য পাচার দমন, স্বচ্ছ ও সুপ্রশাসন নিশ্চিত করা, না কি বিরোধী দলের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এত দিন ধরে নির্দিষ্ট পথ দিয়ে, নির্দিষ্ট উপায়ে লক্ষ লক্ষ গরু পাচার, বা কোটি কোটি টন কয়লা পাচার যে ভাবে হয়েছে, তা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, তার অর্থবণ্টনের নিয়মও সুনির্দিষ্ট। সেখানে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিও সেই অপরাধের দায় অস্বীকার করতে পারে না।
আজ কেন্দ্রকেও প্রশ্ন করা চাই, বিএসএফ পাচার রুখতে পারে না কেন? কেন অভিযুক্ত জওয়ান, অফিসারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি? যে রাজ্যগুলি থেকে গরু আসে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে, তার অনেকগুলিই বিজেপি-শাসিত। ‘গোমাতা’-র সুরক্ষায় তারা প্রায়ই হিংস্র হয়ে ওঠে। অথচ, সে সব রাজ্যে পুলিশ গরুর ট্রাক রুখতে ব্যর্থ কেন? দুর্নীতি এবং অপরাধের প্রতি যে অসীম সরকারি সহিষ্ণুতা দেখছে ভারতবাসী, সেখানে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল মাসতুতো ভাই। বখরা নিয়ে ঝগড়া, নইলে গদি নিয়ে টানাটানি হলে দু’পক্ষের লড়াই বাঁধে, তখন তদন্ত-গ্রেফতারের ধুম পড়ে। বিস্তর ধুলোর আড়ালে বোঝাপড়া হয়ে যায়, পাচার চলে যথা পূর্বং— এমনই এত কাল দেখে এসেছে দেশবাসী। তৃণমূল ও বিজেপি নেতারা দুর্নীতির জন্য ক্রমাগত পরস্পরকে দুষছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত আক্রমণ শিষ্টাচার, শালীনতার সব সীমা লঙ্ঘন করছে। কিন্তু সীমান্তে পাচার বন্ধ হবে, তার কোনও আশ্বাস এখনও মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy