বাংলাদেশে ঐতিহাসিক পালাবদলের পর রাজনীতির চেহারা কী হতে চলেছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ফলে যে কোনও মন্তব্যই এই মুহূর্তে আনুমানিক ও অনিশ্চিত। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর সোমবার বেলা তিনটের সময় সে দেশের সেনাপ্রধানের মুখে যে ঘোষণাটি শোনা গিয়েছিল, তার সব ধোঁয়াও এখনও কাটেনি। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের অধিনায়কত্বে সর্বদলীয় ভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরিকল্পনার কথা জানা গিয়েছে। তবে তার মধ্যে প্রশ্ন অনেক। এমন কোনও সরকার তৈরি করার কাজে সব দলকেই রাখার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু তা কি সত্যিই সম্ভব? সোমবারের সেনাপ্রধান-আহূত বৈঠকেও কেবল জামাত, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বিশিষ্ট জনদেরই ডাকা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য দলের কেউ ছিলেন না। আবার এও ঠিক, সব দল যোগ দিলে আদর্শ ও উদ্দেশ্যের বিভেদ এতটাই বেশি দাঁড়াবে যে আবার নতুন অস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ সব সমস্যা যে-কোনও সঙ্কটকালীন সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রস্তাবের একটি বিশেষ উদ্বেগজনক দিক আছে। নতুন অস্থিরতা তৈরি হলে তা সামরিক শাসনের পথ প্রশস্ত করতে পারে— যা কখনওই সন্তোষজনক বিকল্প হতে পারে না।
আরও একটি গুরুতর বিষয়। সদ্য-প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরই বাংলাদেশের যে সব ধ্বংসাত্মক ছবি দেখল সারা বিশ্ব, তা গভীর উদ্বেগের। রাজনৈতিক অস্থিরতার পথ ধরে যদি মৌলবাদী ইসলামের প্রভাব সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা হবে অতি বিপজ্জনক। বাস্তবিক, ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘুদের প্রাণ ও সম্পদের উপর আক্রমণের কথা জানা গিয়েছে, বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক বাংলাদেশি নেতা-শিল্পী-চিন্তকদের প্রতি জনতার ক্রোধ ধাবিত হতে দেখা গিয়েছে, শেখ মুজিবের মূর্তি নির্মম ভাবে ভাঙা হয়েছে। যত ক্ষণ পর্যন্ত না এই আক্রমণ ও বিদ্বেষকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে, তত ক্ষণ ও দেশের নতুন পালাবদলের প্রকৃত চরিত্র বোঝা যাবে না।
এমনিতেই গত মাসাধিক কাল ধরে বাংলাদেশে যা ঘটছে, সেই ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপহীন। বহু শত প্রাণ বিনষ্ট। বিশেষ যন্ত্রণার বিষয়— অধিকাংশ নিহতই তরুণ, এমনকি কিশোর। সরকারি সংরক্ষণ নীতিকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলনে প্রশাসনের নির্মম গুলিচালনা ও ছাত্রছাত্রী-সহ অন্যান্যের প্রাণহানি— এই ভয়াবহ ঘটনা থেকে শুরু করে সে দেশে বিক্ষোভ-প্লাবন ঐতিহাসিক আকার নিল। মনে রাখা ভাল, এই সঙ্কট কোনও একটিমাত্র ঘটনার ফল নয়, হতে পারে না। স্পষ্টতই, পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরুদ্ধে বহু দিন ধরে ক্ষোভের বারুদ জমছিল। তাঁর ও তাঁদের বিরুদ্ধে ছিল কর্তৃত্ববাদী অপশাসনের অভিযোগ, লাগামছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ, বিরোধীদের উপর তীব্র দমন ও নিষ্পেষণের অভিযোগ, একের পর এক নির্বাচনে বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়ার অভিযোগ। মানুষের রাগ পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল— বামে, দক্ষিণে, মধ্যগামীদের মধ্যে। আসল কথা, গণতন্ত্রের আবরণে কর্তৃত্ববাদ প্রবেশ করলে তার পরিণতি কেমন হয়, এবং কত দ্রুত তা ঘটতে পারে, ইতিহাস বার বার তা দেখিয়েছে। আবারও দেখাল। ভারতের অতি আস্থাভাজন নিকট প্রতিবেশী দেশ— বাংলাদেশ। ফলে ভারতের পক্ষেও এ এক অস্থির মুহূর্ত। পলাতক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এখনও দিল্লির আশ্রয়ে আছেন— স্বভাবতই দিল্লিকে অতি সতর্ক পদক্ষেপ করতে হচ্ছে। সতর্ক থাকতে হবে ভারতীয় নাগরিক সমাজকেও, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে। বুঝতে হবে যে, অনেক আগুন জ্বলা, অনেক প্রাণের দাম দিয়েছে বাংলাদেশ। এ বার সে দেশে দ্রুত স্থিরতা ও স্থিতি ফিরুক। ফিরুক গণতন্ত্র। ভারতীয় রাষ্ট্র ও ভারতের নাগরিক সমাজের দিক থেকে এটাই এখন প্রধান কাম্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy