হাসপাতালে ভর্তি সেই দিনের কিশোরী মেয়েটি আজ হয়তো সফল চিকিৎসক হইয়া কাজ করিত। পিতামহকে হারানো সেই দিনের স্কুলপড়ুয়া আজ স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। ২০১১ সালে ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের অভিশপ্ত দুর্ঘটনায় ৯২ জন মারা গিয়াছিলেন, দুঃসহ স্মৃতিভার লইয়া জীবন কাটাইতেছেন অগণিত আত্মীয়-বন্ধু। জীবন ও সময়, দুই-ই নিজস্ব নিয়মে বহিয়া যায়, ৯ ডিসেম্বরের সেই দুর্ঘটনার পরে দশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। সাফারি পার্কের বেদিতে প্রতি বৎসর ধূপ-দীপ-মালা পড়িয়াছে, আমরি-কাণ্ডে মৃতদের পরিজন বালকটি তরুণ হইয়াছে, মধ্যবয়স্কা প্রৌঢ়া হইয়াছেন, শুধু একটি মীমাংসা আজও হয় নাই: অভিযুক্তদের বিচার। আলিপুর কোর্টে মামলা চলিতেছে, ৩০ নভেম্বরের পরে শুনানির দিন ধার্য হইয়াছে নতুন বৎসরের ১০ জানুয়ারি। আর ক্রমশ দূরে সরিয়া যাইতেছে বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচারের আশা।
দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া শেষের খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়, তবে তাহা বিরল ব্যতিক্রম। সেই মামলার অপরাধ-অভিযোগগুলিও তেমন গুরুতর বলিয়াই, কিংবা সমাজে তাহাদের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিবেচনাতেই সংশ্লিষ্ট আদালত বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। আমরি হাসপাতালে আগুনের বিষবাষ্পে দমবন্ধ হইয়া ৯২ জন মানুষের মৃত্যু কলিকাতাকে শোকস্তব্ধ করিয়াছিল, হাসপাতালের অগ্নি-নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত অব্যবস্থা ও অনিয়ম বাহির হইয়া পড়ায় হতবুদ্ধি দশা হইয়াছিল। হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর-সহ ষোলো জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হইয়াছিল ভারতীয় দণ্ডবিধি ও রাজ্য ফায়ার সার্ভিসেস অ্যাক্ট-এর বিভিন্ন ধারায়। তবু এক দশকেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গায়ে আঁচড়টিও পড়ে নাই বলিয়া অভিযোগ— অভিযুক্তেরা জামিনে আছেন। অন্য দিকে চলিতেছে সুদীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া। যে চিকিৎসক ময়নাতদন্ত করিয়াছিলেন, এখন তাঁহার সাক্ষ্যগ্রহণ চলিতেছে— চারশত সাক্ষীর মধ্যে তিনি মাত্র সপ্তম জন। ৯২টি ময়নাতদন্ত রিপোর্টের মধ্যে ৬৫টি আদালতে দেখা হইয়াছে, বাকিগুলিও হইবে। তাহা কবে শেষ হইবে, চারশত সাক্ষীর মধ্যে কত জনের সাক্ষ্য লওয়া হইবে, কত দিন মাস বা বৎসর ধরিয়া, জানা নাই। যে ব্যক্তির দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ আমরি-কাণ্ডে তদন্ত শুরু করিয়াছিল, সেই মানুষটিও ইতিমধ্যে মারা গিয়াছেন।
ভারতের আদালতগুলিতে মামলার পাহাড়, বিচারক ও আইনকর্মীর অপ্রতুলতা, পরিকাঠামোর দৌর্বল্য অবিদিত নহে। তাহার পরেও আমরি-কাণ্ডের ন্যায় এক-একটি মামলার দীর্ঘসূত্রতা দেখিয়া প্রশ্ন জাগে, কোনও অবস্থাতেই কি এই বিচারপ্রক্রিয়ায় গতি আনা যাইত না? আমরি-র দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়াছে, কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ক্ষেত্রে ভারতীয় আইন এখনও সর্বৈব কঠোর নহে, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বিস্তর ফাঁক রহিয়াছে। ব্রিটেনের ন্যায় ভারতে ‘কর্পোরেট ম্যানস্লটার অ্যান্ড কর্পোরেট হোমিসাইড অ্যাক্ট’ নাই, সংস্থার ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জেরে নাগরিকের মৃত্যু ঘটিলেও কর্তৃপক্ষ আইনি ফাঁক গলিয়া বাহির হইয়া যাইতে পারে। এই আইন যেমন প্রয়োজন, বিচারপ্রক্রিয়ার দ্রুতিও তেমনই জরুরি। বিলম্বিত বিচার যে আসলে প্রত্যাখ্যানেরই নামান্তর, বহুচর্চিত এই কথাটি ভারতের বিচারব্যবস্থা আর কবে বুঝিবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy