ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতি অত্যন্ত বেশি পরিমাণে তাহার বিচারব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল, এমন অভিযোগ নূতন নহে। সাম্প্রতিক সময়ে এই নির্ভরতা যেন পূর্বাপেক্ষা আরও বহু গুণ বাড়িয়াছে, এবং বিচারব্যবস্থার দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া ব্যক্তিনাগরিকের নিজেকে রক্ষা করিবার অন্যবিধ কোনও উপায় থাকিতেছে না। প্রশ্ন হইল, বিচারবিভাগও কি সর্বস্তরে তাহার এই বিরাট দায়িত্ব ও ভূমিকা বিষয়ে সুবিবেচনার পরিচয় দিতেছে? গত সপ্তাহে সিবিআই-এর নারদ মামলার সূত্রে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বক্তব্যের একটি অংশ এই প্রসঙ্গে বিশেষ মূল্যবান। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটি পশ্চিমবঙ্গের যে চার মন্ত্রী ও নেতাকে কারারুদ্ধ করিয়াছিল, তাঁহাদের জামিনের অধিকার কলিকাতা হাই কোর্টের স্পেশাল বেঞ্চ নাকচ করিয়া দেয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মূল্যবান পর্যবেক্ষণ— আদালতের স্পেশাল বেঞ্চ আহূত হয় নাগরিক অধিকার রক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করিতে, নাগরিকের অধিকার কাড়িয়া লইবার জন্য নহে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই মন্তব্য। সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় নাগরিকের অধিকার যত ভাবে অবহেলিত ও দলিত হইবার নিদর্শন দেখা গিয়াছে, তাহাতে বিচারবিভাগের এই আত্ম-পর্যালোচনা বিশেষ জরুরি, এবং সময়োচিত। বিচারের প্রতিটি স্তরে যদি নাগরিক অধিকারের বিষয়টিকে একটি প্রধান বিবেচ্য হিসাবে না-দেখা হয়, তবে ক্ষমতালোভী নীতিবিরহিত রাজনীতির দাপটে পদে পদে লাঞ্ছিত ও নিষ্পেষিত হওয়া ছাড়া ভারতীয় সমাজের গতি থাকে না। নারদ মামলা বিষয়েও কথাটি একই রকম প্রযোজ্য।
সিবিআই-এর পক্ষে যুক্তি ছিল, অভিযুক্ত নেতারা বিশেষ প্রভাবশালী— তাঁহারা জামিন পাইলে তথ্যপ্রমাণ নষ্টের প্রয়াস হইতে পারে। শীর্ষ আদালত প্রবল ভর্ৎসনার সুরে প্রশ্ন করিয়াছে: এমন তো নহে যে, সকল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হইয়াছে; সে ক্ষেত্রে যুক্তি কী বলে— যাঁহারা ধৃত হন নাই, তাঁহাদের তথ্যপ্রমাণ লোপাটের সম্ভাবনা বেশি, না কি যাঁহারা ধৃত হইয়াছেন, তাঁহাদের? সাক্ষীদের প্রভাবিত করিবার কথাই যদি উঠে, তবে এই মুহূর্তে কোন ব্যক্তিদের পক্ষে তাহা করিবার পথ প্রশস্ত? প্রশ্নটির ধার সিবিআই তথা কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠীকে বিদ্ধ করিতে বাধ্য, কেননা, সেই অভিযুক্ত নেতাদেরই এখনও ধরা হয় নাই, যাঁহারা ইতিমধ্যে বিজেপিতে যোগদান করিয়াছেন। সিবিআই যে কেন্দ্রীয় শাসকের পুতুল হিসাবে কাজ করিতেছে, বিরোধীদের বিপাকে ফেলিবার ব্রহ্মাস্ত্র হিসাবে কাজ করিতেছে— ইহা এখন আর কোনও অনুমাননির্ভর অভিযোগ নহে, বরং তথ্যনির্ভর সত্য। আদালতের ভর্ৎসনায় যেন সেই সত্যেরই প্রতিচ্ছবি।
ধৃত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা বোঝা যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিবিআই অফিসে ধর্না হইতেই, এমন একটি যুক্তি শুনাইয়াছিলেন সলিসিটর-জেনারেল তুষার মেহতা। কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এই ধর্না উচিত কাজ হইয়াছিল কি না, ইহা আলাদা করিয়া বিতর্কের বিষয় হইতেই পারে, কিন্তু ধৃত নেতৃবর্গের নাগরিক অধিকার ইহাতে খর্বিত হইতে পারে না। স্বাভাবিক যুক্তিও ইহাই, সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিরাও তাহাই বলিয়াছেন। নারদ মামলায় অভিযুক্ত নেতাদের অপরাধের যুক্তিযুক্ত বিচার, এবং কয়েক বৎসরের ধারাবাহিক নীরবতার পর হঠাৎ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন-উত্তর কোভিড-ধ্বস্ত পরিস্থিতিতে তাঁহাদের গ্রেফতার এবং তাঁহাদের বক্তব্য পেশ করিবার সুযোগ না দিয়া জামিনবিহীন হাজতবাসে বাধ্য করানো— বিচারবিভাগীয় নিরপেক্ষতার দিক দিয়া যে দুইটি বিষয় এক নহে, এই বোধের লোপ দেখিয়া পশ্চিমবঙ্গের, এবং সমগ্র দেশের, নাগরিক-মাত্রেই শিহরিত। নিরপেক্ষ, নীতিনিষ্ঠ বিচারের অঙ্গনই তাঁহাদের একমাত্র ভরসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy