২০১৪ সালেও সংসদ ভবনে মহাপ্রবেশের মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী একই মুদ্রায় প্রণিপাত করেছিলেন। ফাইল চিত্র।
এখন অষ্টপ্রহর জুড়ে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। নাগরিকের বিস্ফারিত নয়নের সম্মুখে চলতে থাকে তাদের অবিরত প্রদর্শনী। তবে কোনও কোনও দিন তার মধ্যেও বিশেষ। যেমন গত রবিবার। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে রাজধানীতে সে দিন যে দৃশ্যগুলির জন্ম হল, প্রধানমন্ত্রী কথিত ‘নতুন ভারত’-এর সচিত্র জীবনকাহিনিতে তাদের জন্য অবশ্যই পাকা জায়গার বন্দোবস্ত হবে। দাক্ষিণাত্যের মন ওরফে ভোট পাওয়ার কৌশল হিসাবে আবিষ্কৃত রাজদণ্ড হাতে নরেন্দ্র মোদীর সাড়ম্বর গজেন্দ্রগমন, মন্ত্রোচ্চারণ সহযোগে যজ্ঞানলে ভৃষ্টধান্য বা খদিকা (খই) অঞ্জলি, বক্তৃতার সূচনায় ‘হর হর মহাদেব’ ধ্বনি প্রক্ষেপণ ইত্যাদি অষ্টোত্তর শতচিত্রকে অতিক্রম করে যে ছবিটি সম্ভবত সর্বাধিক প্রচারিত হয়েছে এবং হয়ে চলবে, সেটি সদ্য-প্রতিষ্ঠিত সেঙ্গোলের সামনে লাল গালিচায় তাঁর সাষ্টাঙ্গ প্রণামের দৃশ্য। ২০১৪ সালেও সংসদ ভবনে মহাপ্রবেশের মুহূর্তে তিনি একই মুদ্রায় প্রণিপাত করেছিলেন। কিন্তু পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। প্রচার-প্রাজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন, সহস্রচক্ষু প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে এমন দৃশ্য এক লহমায় তাঁর এক হাজার মন কিবাত-এর কাজ করে দেবে, দিকে দিকে সাধুবাদ উচ্চারিত হবে: অহো! গণতন্ত্রের প্রতি দুনিয়ার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের অধিনায়কের কী সুগভীর, সম্পূর্ণ, সাষ্টাঙ্গ শ্রদ্ধা!
কিন্তু রাজদণ্ড তো রাজার দণ্ড, তাঁর ক্ষমতার প্রতীক। গণতন্ত্রে তার স্থান কোথায়? সুকুমার রায়ের নেড়া বলত, ওই শিশিবোতলের জায়গাটা একটু কঠিন বটে। ভারতের স্বাধীনতা তথা ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিহাসে সেঙ্গোলের ভূমিকা এবং পরবর্তী কালে তার প্রতি নেহরু ও তাঁর উত্তরসূরিদের ‘উপেক্ষা’র কথা ও কাহিনি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিস্তর সওয়াল-জবাব শোনা গিয়েছে, কিন্তু সেই বিতর্কের ঘোলা জলে অবগাহন না করেও একটি কথা বুঝে নিতে কোনও অসুবিধা নেই। অতীতে যা-ই ঘটে থাকুক, একুশ শতকের তৃতীয় দশকে গণতান্ত্রিক ভারতের আইনসভার নবনির্মিত পরিসরে রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারের কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। এই প্রয়োজন গণতন্ত্রের নয়, দেশবাসীরও নয়, রাজদণ্ড ফিরে এসেছে শাসকের নিজস্ব প্রয়োজনে। এবং তা নিছক তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে পা রাখার প্রয়োজন নয়, গণতান্ত্রিক বাতাবরণে রাজাধিরাজের আধিপত্য ও মহিমাকে প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন। সংসদ ভবন উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতির স্বাভাবিক ভূমিকা থেকে তাঁকে সম্পূর্ণ সরিয়ে রেখে যে ভাবে সমগ্র আয়োজনটিকে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর একক অনুষ্ঠানে পরিণত করা হল এবং রাষ্ট্রপতির বিবৃতিতে সেই প্রক্রিয়াকেই যথাযথ বলে শংসাপত্র দেওয়া হল, তা জানিয়ে দেয়, এই ‘নতুন ভারত’ পোশাকে ও অঙ্গসজ্জায় গণতন্ত্রকে প্রণাম করে আপন মজ্জায় মজ্জায় যে নীতি ও আদর্শকে বরণ করে নিতে বদ্ধপরিকর, তার নাম নায়কতন্ত্র।
সেই তন্ত্র সাধনার প্রকরণ হিসাবে হিন্দুত্ববাদকে কব্জি ডুবিয়ে ব্যবহার করবার যে রীতি এই শাসকরা পালন করে চলেছেন, রবিবারের আয়োজনটি ছিল তারও এক অভূতপূর্ব প্রদর্শনী। বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা সম্বলিত একটি সংক্ষিপ্ত প্রভাতী অনুষ্ঠান রাখতে আয়োজকরা ভোলেননি, কিন্তু সংসদ ভবনের মূল পর্বটি এমন ভাবে আপাদমস্তক ধর্মীয় আচারে পরিপূর্ণ যে তাকে কোনও আধুনিক মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠান বলে বিভ্রম ঘটবার যথেষ্ট কারণ আছে। বস্তুত, এই ‘বিভ্রম’কে সত্য করে তোলাই বোধ করি শাসকদের প্রকৃত লক্ষ্য। হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সেই লক্ষ্য পূর্ণ করতে চান তাঁরা। জন্মমুহূর্তেই নতুন সংসদ ভবনকে তার সাধনভূমি রূপে চিহ্নিত করা হল। দেশবাসী এবং তাঁদের প্রতিনিধিরা যথার্থ গণতন্ত্রের সাধনার মধ্য দিয়ে শাসকদের এই উদ্যোগকে প্রতিহত করতে পারবেন কি না, ইতিহাস তা বলবে। সংসদ ভবন হবে সেই ইতিহাসের এক পরীক্ষাগার। নিছক পরীক্ষা নয়, অগ্নিপরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy