Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Atul Prasad Sen

‘বাস রে ভালো’

রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত খামখেয়ালি সভায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন অতুলপ্রসাদও।

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২১ ০৫:০৪
Share: Save:

আমি কি প্রার্থনা করি ভগবানের কাছে জানো? শ্মশানে যেদিন আমাকে নিয়ে যাবে সেদিন চিতায় শুয়ে হঠাৎ যেন সকলের দিকে চেয়ে একবার হেসে তবে চোখ মুদি।— এমন কথা যিনি বলিতে পারিতেন, তিনিই তো লিখিবেন ‘সবারে বাস রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে।’ বাংলা গানের জগতে অতুলপ্রসাদ সেন এক অসামান্য তারকা, যিনি সত্যই তারকার ন্যায় দ্যুতিময়, দীপ্তিমান হইয়াও শেষ পর্যন্ত সূর্যের দাপটে আর চন্দ্রের প্রভার সম্মুখে যেন খানিক অলক্ষ্যেই বিচরণশীল। এই বৎসর তাঁহার সার্ধশতবর্ষ পূর্তিতে বাঙালি তাঁহাকে স্মরণ করিয়াছে ঠিকই, কিন্তু নামমাত্র সেই স্মরণ থাকিয়াছে নীরব ও উৎসাহহীন— অথচ ‘উঠো গো ভারত-লক্ষ্মী’র ন্যায় জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান ঘরে ঘরে উপহার দিয়াছেন তিনিই। রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতির সুরবিশ্বে অতুলপ্রসাদ যেন অগোচরে এক অপূর্ব মায়া ছড়াইয়া গিয়াছেন। তাঁহার গান বলিতে সাধারণ্যে যতই ভক্তিগীতি বুঝিয়া থাকুক, সেই গান প্রকৃত অর্থে মানবভক্তির গান। তাঁহার অন্তর-উৎসারিত ভক্তি সব রকম সঙ্কীর্ণ ধর্মীয়-সামাজিক গণ্ডি ভেদ করিয়া যাইত— সেই অর্থে বাংলার ভক্তি-বাদের ঐতিহ্যকেই ঊনবিংশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের প্রথম তিনটি দশকে তিনি রূপ দিতেছিলেন।

ভক্তি-গীতিকার বলিতে যে মনুষ্যচরিত্রটি চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে, অতুলপ্রসাদ সেন কিন্তু ঠিক তেমনটি ছিলেন না। সফল আইনজীবী, তিনি লখনউ শহরের ‘বার’-এ যথেষ্ট কৃতী হিসাবে পরিচিত হইয়াছিলেন। অবধ বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। প্রবাসে বসিয়া বাংলা সাহিত্যের উন্নতিকল্পে অনেক ভাবনা ভাবিয়াছিলেন, যাহার কিছু প্রতিফলিত হইয়াছিল লখনউয়ের প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভায়, যাহা এখন নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন নামে পরিচিত হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথের ন্যায় তারকা সাহিত্যিকদের বরণপূর্বক সভা পরিচালনার ভার পড়িত তাঁহার উপর। যে সময়ে জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসারে বাঙালি নেতারা ব্যস্ত, তেমন সময়ে অতুলপ্রসাদ সেন মনে করিয়াছিলেন যে, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিপুল দিগন্ত উন্মোচিত হইবে দেশের ইতিহাসের উজ্জ্বল উদ্ধারে। বলিয়াছিলেন, যদুনাথ সরকার বা রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের হাতে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস লিখিত হউক, পাশাপাশি হিন্দি ভাষার পণ্ডিতদের নিকট হইতে মীরাবাই, রহিম, সুরদাস, তুলসীদাস, কবীরের কাব্যকৃতি এবং উর্দুভাষায় পারদর্শীদের নিকট হইতে গালিব, আকবর, হালি প্রভৃতি কবির কাব্যভান্ডার হইতে রত্ন আহরিত হউক। বাংলা সঙ্গীতজগতে তাঁহারই বিশিষ্ট অবদান— ঠুংরি গীতিছন্দে গান নির্মাণ। ব্রাহ্ম সমাজের ধ্বজাধারী হইতে কাজী নজরুল ইসলাম, সকলেই অতুলপ্রসাদের গানে মুগ্ধ শ্রোতা ও গায়ক ছিলেন। অর্থাৎ, বাঙালি জাতীয়তার একটি বৃহৎ রূপের পিয়াসি ছিলেন তিনি, ‘সবারে বাস রে ভালো’-র এক অন্যতর আকাঙ্ক্ষা তাঁহার কাজে প্রতিফলিত হইত আজীবন। রবীন্দ্রনাথ এই স্বভাবত উদার ও উদাস প্রবাসী বন্ধুটির কথা ভাবিতে ভাবিতে লিখিয়াছিলেন: “বন্ধু, তুমি বন্ধুতার অজস্র অমৃতে/ পূর্ণপাত্র এনেছিলে মর্ত্য ধরণীতে/ ছিল তব অবিরত/ হৃদয়ের সদাব্রত/ বঞ্চিত করোনি কভু কারে/ তোমার উদার মুক্তদ্বারে।”

রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত খামখেয়ালি সভায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন অতুলপ্রসাদও। রাজনীতি, শিল্প, সমাজ বিষয়ে তর্কবিতর্কে মাতিতেন তাঁহারা। কিন্তু কেবল ‘খামখেয়াল’ নহে, এই অন্য বরেণ্য সদস্যদের মতো অতুলপ্রসাদও কিন্তু সদাব্যস্ত থাকিতেন নানা পার্থিব খেয়ালে। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন তিনি। সেখানকার রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সহিতও তাঁহার ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। সমাজসেবার কাজে কাটাইতেন অনেক সময়। নিজের খরচে রোগীদের জন্য মায়ের নামে শুশ্রূষালয় তৈরি করিয়াছিলেন। মৃত্যুর আগে সেবাশ্রমের জন্য নিজের সামান্য সঞ্চয়ের কিছু অংশ নিয়মিত ভাবে দানের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। তাঁহার বিচিত্র কৃতি, বিবিধ আগ্রহ যে কোনও বাঙালির কাছে স্মরণীয় ও শরণীয় হইতে পারে। তবু তিনি যেন খানিক বিস্মৃত, খানিক অবহেলিত। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, যে বাঙালি ভাবজগতে ঐতিহ্যের অর্থ ক্রমশই একমাত্রিক হইয়া আসিতেছে— অতুলপ্রসাদের মতো বহুমাত্রিক ভাবুক সেখানে উত্তরোত্তর বেমানান।

যৎকিঞ্চিৎ

তুরস্কের জঙ্গলে জোর খোঁজ চলছিল এক নিরুদ্দিষ্ট লোকের, ঘণ্টাকয় পরে এক জন যেই না নাম ধরে চেঁচিয়েছে, দলেরই আর এক জন সাড়া দিল, এই যে আমি! মানে, যাকে খোঁজা হচ্ছে, সেও ছিল দলেরই সঙ্গে, সেও খুঁজছিল। নিজেকেই। সেই নিয়ে থানা-পুলিশ, হাসাহাসি। লোকটা নাহয় আগের রাতে জব্বর পান করেছিল, তবু কেউ বুঝতে চাইছে না বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন— বিশ্বের যত শাস্ত্র আর মনীষী এ কথাই বলে গেছেন, নিজেরে হারায়ে খুঁজি। ভিড়ে মেশে সবাই, আত্মসন্ধান করে ক’জন?

অন্য বিষয়গুলি:

Atul Prasad Sen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy