প্রতীকী ছবি।
অলিম্পিক্স খেতাবজয়ী লাভলিনা বরগোহাঁই বলিয়াছেন, ‘স্বাধীনতা’ মানে তাঁহার নিকট এমন এক সমাজ, যেখানে তিনটি কন্যাসন্তানের মা গর্বের হাসি হাসিতে পারেন। এই কথার অন্তঃস্থিত বেদনা কাহার মনকে আন্দোলিত না করিবে? লাভলিনা তাঁহার মায়ের তৃতীয় সন্তান, তৃতীয় কন্যা। কন্যার মায়ের প্রতি বর্ষিত অবমাননা তিনি নিত্যই দেখিয়াছেন। তাঁহারা তিন বোন আপন আপন কৃতিত্ব, সাফল্য দিয়া মায়ের লাঞ্ছনামুক্তির পথ খুঁজিয়াছেন। কিন্তু যে দেশ কন্যাসন্তানকে গর্ভেই বিনষ্ট করিবার পক্ষপাতী, কন্যার জন্ম দিবার ‘অপরাধে’ জননী যেখানে প্রায়ই নির্যাতিত, সেখানে অলিম্পিক্সে সেরা হইলেও কি একটি মেয়ে আপন ভাগ্য জয় করিতে পারেন? লিঙ্গ ও বর্ণের পরিচিতি দিয়া ব্যক্তিকে আজীবন শৃঙ্খলিত করিয়া রাখিবার প্রয়াস চলিতেছে, আজও সমাজ তাহাকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করিতে অভ্যস্ত। আরও এক অলিম্পিক্স-কন্যা তাহার সাক্ষী। বন্দনা কাটারিয়া প্রথম ভারতীয় মহিলা হকি খেলোয়াড়, যিনি অলিম্পিক্সে ‘হ্যাটট্রিক’ করিয়াছেন। খেলার শেষ পর্যায়ে ভারতীয় মহিলা হকি দলের পরাজয় ‘উদ্যাপন’ করিয়াছেন বন্দনার কিছু উচ্চবর্ণ প্রতিবেশী। বন্দনার পরিবারকেও ‘দলিত’ বলিয়া অসম্মান এবং আক্রমণ সহিতে হইয়াছে।
নারী, দলিত, আদিবাসী, অথবা ভিন্ন ধর্মের মানুষ ‘সমান’ বলিয়া সম্মান পাইতে পারেন, এই সম্ভাবনা এখনও অনেকে স্বীকার করিতে নারাজ। এই ভয়ানক ভ্রান্তি হইতে যে সমাজ মুক্তি পায় নাই, তাহাকে ‘স্বাধীন’ বলা যায় কী রূপে? এই প্রশ্নটি স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের বিশেষ ভাবে ভাবাইয়াছিল। স্বাধীন ভারত পাইবার জন্য বিদেশি সরকারের সহিত সংঘাতের পাশাপাশি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, বর্ণ ও লিঙ্গ-ভিত্তিক অসাম্যের বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রাম করিয়াছিলেন। মহাত্মা গাঁধী তাঁহার সমাজ আন্দোলনে, রবীন্দ্রনাথ তাঁহার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সুভাষচন্দ্র তাঁহার সেনাবাহিনীতে বর্ণ ও লিঙ্গের ভেদাভেদ রাখিতে দেন নাই। সকলকে সমান মর্যাদা, সমান দায়িত্বে বরণ করিয়া স্বাধীনতার স্বরূপটি দেশের সম্মুখে রাখিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু ভারতবাসী পূজার ছলে ভুলিয়া থাকিতে বড়ই দক্ষ— সেই মহামূল্য দৃষ্টান্তগুলিকে কেবল ইতিহাস বইয়ের পাঠ্য করিয়া রাখিয়াছে, সমাজের গায়ে তাহার ছোঁয়া লাগিতে দেয় নাই।
বরং অসাম্যের অন্ধকার আরও গাঢ় হইয়াছে। অনাহার-অশিক্ষা-পীড়িত ভারতে নেতারা আশা করিয়াছিলেন যে, শিক্ষা বাড়িলে, খাদ্যাভাব ঘুচিলে অজ্ঞানতা-প্রসূত ভেদাভেদ আপনিই মিলাইয়া যাইবে। তাঁহাদের সেই আশা ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়াছে— একবিংশ শতকের ভারতে শিক্ষার হার বাড়িয়াছে, খাদ্য নিরাপত্তা আসিয়াছে, কিন্তু নারীবিদ্বেষ কমে নাই। অতএব, পঁচাত্তর বৎসর পার করিয়া ফের চিন্তা করিতে হইবে, স্বাধীনতার অর্থ কী? যাহা বাহ্যিক সম্পদ, তাহা এক বার হস্তগত হইলে তুলিয়া রাখিলেই চলে। অন্তরের সম্পদকে রোজ মাজিয়া-ঘষিয়া লইতে হয়, তাহার মূল্য পরখ করিতে হয়। অপরের প্রতি অকারণ বিদ্বেষ মানুষকে হিংসা ও ভীতিতে সতত আবদ্ধ করিয়া রাখে। আজ দেশের এক অসামান্য কন্যা স্বাধীনতার যে ন্যায়পূর্ণ, সাম্যদীপ্ত ধারণা দেশের সম্মুখে রাখিলেন, তাহাই কি প্রকৃত স্বাধীনতার পথ নহে? সেই লক্ষ্যে পৌঁছাইতে দেশকে বহু পথ হাঁটিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy