একটি যুদ্ধ চলিতেছে। তাহার এক দিকে যুক্তি, শাস্ত্র এবং সাধারণ বুদ্ধি, অপর দিকে বিত্ত, ক্ষমতা এবং পক্ষপাত।” রামমোহন রায় কথাগুলি বলিয়াছিলেন ১৮৩১ সালে। লন্ডনে উদারপন্থী, যুক্তিবাদী ‘ইউনিটারিয়ান’ খ্রিস্টানদের সম্মুখে তাঁহার ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করিয়াছিলেন, বিবেক ও বিচারের আলোকে উজ্জ্বল ধর্মবুদ্ধির জয় হইবে, পরাজিত হইবে রহস্যের দ্বারা সত্য আবৃত করিয়া মানুষকে ভুলাইয়া রাখিবার চেষ্টা। রামমোহন রায়ের জন্মের সার্ধদ্বিশতবার্ষিকী পালন করিল দেশ, ভারতের স্বাধীনতারও পঁচাত্তর বৎসর হইতে চলিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আজও ধর্মের মহিমায় দেশবাসীকে ভুলাইয়া রাজনীতি পরিচালনা করিতে চায়। ক্ষমতা, বিত্ত এবং ধর্মান্ধতার ত্র্যহস্পর্শ হইতে মুক্তি পাইতে আজও যুদ্ধ করিতে হইতেছে এই দেশের অগণিত মানুষকে। তাহাদের উপর যে অপমান, পীড়ন ও হিংসা বর্ষিত হইতেছে, তাহার বেদনা সর্বপ্রথম অনুভব করিয়াছিলেন রামমোহন রায়। পরিবার, সমাজ হইতে শাসক-যাজক, সকল পক্ষ হইতে তাঁহার প্রতি অবিরাম আঘাত আসিয়াছিল। তবু তিনি আপন কর্তব্য আপনিই নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন, এবং তাহা হইতে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নাই। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “তিনি ছিলেন একক, তিনি ছিলেন নিন্দিত।” বুকের পাঁজর জ্বালাইয়া অপরকে পথ দেখাইয়াছিলেন, যে পথে হাঁটিয়া ধর্ম ও জাতির ঊর্ধ্বে একটি রাষ্ট্র হইয়াছে ভারত। সেই বিপদসঙ্কুল যাত্রা আজও শেষ হয় নাই। সাধারণত ঐতিহাসিক চরিত্র আলোচনায় আসিলে প্রশ্ন উঠে, তিনি কি আজও প্রাসঙ্গিক? রামমোহনের ক্ষেত্রে প্রশ্নটি সম্পূর্ণ ঘুরিয়া যায়। সন্দেহ জাগে, একবিংশের ভারত কি এই মহামানবের নাগাল পাইয়াছে? তাঁহার দৃষ্টির উদারতা, চিন্তার স্বচ্ছতা, তাঁহার সহজ মানবিকতা ও আপসহীন নৈতিকতা, সর্বোপরি, সকল মানুষে সমদৃষ্টির দ্বারা পরিচালিত তাঁহার ধর্মবোধ, কতটুকু অনুসরণ করিতে পারিয়াছে আধুনিক ভারত? নাগরিকের স্বাধীনতা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করিতে তিনি শাসকের সহিত নিরন্তর লড়াই করিয়াছেন, আবার সমাজের অচলায়তন ভাঙিতে রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগাইয়াছেন। সংস্কারের এমন সার্বিক প্রচেষ্টা ভারত কতই বা দেখিয়াছে?
রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মদিন (২২ মে, ২০২১) বর্ষব্যাপী উদ্যাপনের সূচনা করিল। যে কোনও বিশাল মানবকে বুঝিবার চেষ্টা অন্ধের হস্তিদর্শনের ন্যায়, বিশেষত রামমোহনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বহু তথ্য হারাইয়া গিয়াছে। তবু তাঁহার নিজের লিখিত গ্রন্থ, পুস্তিকা, প্রচারপত্র, তাঁহার বক্তৃতার অনুলিপি, এবং তাঁহার সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য কম নাই। আশা থাকিয়া যায়, তাঁহার সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনি ও ধারণাগুলিকে অতিক্রম করিয়া তাঁহার চিন্তাজগতের গভীরতায় প্রবেশ করিবে সমাজ, সংস্কারের চেষ্টার পশ্চাতে তাঁহার যুক্তিগুলিকেও গ্রহণ করিবে। উদাহরণস্বরূপ, সতীদাহ রোধে তাঁহার উদ্যোগ যে ভাবে পরিবেশিত হইয়া থাকে, তাহাতে সাধারণের মনে ধারণা জন্মাইতে পারে যে, কতিপয় ধর্মান্ধ মানুষের হাত হইতে বিপন্ন নারী উদ্ধারই ছিল তাঁহার মাহাত্ম্য। সতীপ্রথা, কুলীনপ্রথা ঘুচিয়াছে, অতএব রামমোহনও ইতিহাসের পাতায় সীমিত হইয়াছেন। এই ধারণা ভ্রান্ত। সতীদাহ এবং বহুবিবাহের মূলে রহিয়াছে উত্তরাধিকারের আইন ও রীতি, রামমোহন তাহা দেখাইয়াছেন। নারীর সম্পদবঞ্চনা যত দিন থাকিবে, তত দিনই চলিবে রামমোহনের যুদ্ধ। প্রাচীন শাস্ত্রের সহিত আধুনিক আইন যুক্ত হইয়াছে, তবু ক্ষমতা ও বিত্তের জোর কমে নাই। পুরুষতন্ত্রকে নস্যাৎ করিবার পৌরুষ তাঁহার মতো আর কাহার আছে?
অপর যে যুদ্ধে নামিয়া তাঁহাকে বারংবার স্মরণ করিতে হয়, তাহা সংবাদের স্বাধীনতার। ভারতের সংবাদপত্রের জন্মকালে তিনি এক প্রাণপুরুষ, এবং সংবাদের স্বাধীনতার যুদ্ধেরও তিনি পথিকৃৎ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কলম ধরিতে এক ইংরাজ সম্পাদকের দেশ ছাড়িবার হুকুম হইলে রামমোহন সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে টাউন হলে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। লিখিলেন, স্বৈরাচারী শাসক স্বভাবতই বাক্স্বাধীনতা দমন করিতে চাহে। কিন্তু সাম্রাজ্যের কোথায় কী ভ্রান্তি ঘটিতেছে তাহা শাসকের অগোচর থাকিবে, যদি না ব্যক্তির মতপ্রকাশের বাধাহীন স্বাধীনতা থাকে। আজ ভারতে সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারত পিছাইতেছে। রবীন্দ্রনাথ যাঁহাকে বলিয়াছেন ‘ভারতপথিক’, ভারত কি তাহার পথে চলিয়াছে?
যৎকিঞ্চিৎ
গুদামে উই লাগলে গরুর চোখে জল আসে, জানা কথা। কিন্তু, কুমিরের চোখে জল আসে কেন? কুমির খাওয়ার সময় কাঁদে বটে, কিন্তু অন্য সময় কেন কাঁদে তা কেউ জানে না। এখানেই কুমিরের রহস্য— কোন লোককে দেখানোর জন্য চোখে জল আনতে হবে, আর কোন লোকের জন্য মুখ মুছে নিলেই হয়, সেটা শুধু কুমির জানে। তবে, কুমির তবু কাঁদে; জলহস্তীর চোখে সেই মিথ্যে জলটুকুও কেউ দেখেনি। জলহস্তী সম্ভবত অ্যাংরি ইয়ং ম্যান, আর কুমির হল সুখেন দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy